আমেরিকার দাস-প্রথার সাথে ইসলামের গভীর সম্পর্ক

শুরুর দিকের ইতিহাস
উত্তর আমেরিকায় যে আফ্রিকান দাসদের পাঠানো হত, তাদের অধিকাংশকেই মূলত নিয়ে আসা হত পশ্চিম আফ্রিকা থেকে। পুরুষ, মহিলা এবং শিশু – সকলকে আফ্রিকা থেকে ধরা হত, তাদের বন্দি করে রেখে দাস ব্যবসায়ীদের বিক্রি করে দেওয়া হত। এর পরে তাদের জাহাজে চাপিয়ে দেওয়া হত এবং অত্যন্ত অমানবিক ভাবে তাদের দীর্ঘ যাত্রার মাধ্যমে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হত। আধুনিক ইতিহাসবিদদের ধারণা, অষ্টদশ শতাব্দীতে যখন আমেরিকায় দাস ব্যবসা তুঙ্গে, সেই সময় অন্তত ৭ মিলিয়ন বা ৭০ লাখ আফ্রিকানকে এভাবে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। অনুমান করা হয় যে, উত্তর আমেরিকায় যে আফ্রিকানরা দাসত্ব করত তাদের মধ্যে ৩০% মুসলমান ছিল।
উত্তর আমেরিকায় মুসলিম দাসদের ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগে দাসত্ব সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা আবশ্যক, কারণ এই প্রথা আফ্রিকা এবং বিশেষত পশ্চিম আফ্রিকাতে ইসলামের ইতিহাস এর আগেও বিদ্যমান ছিল। সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাসে পরিণত করা হত, এবং কিছু ক্ষেত্রে অপরাধের শাস্তি হিসাবে বা ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তকে দাস-এ পরিণত করা হত। তবে দাস-প্রথা সেখানে খুব একটি প্রচলিত ছিল না, ফলে দাসের সংখ্যা খুবই কম ছিল। আফ্রিকানরা সাধারণত তাদের নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীভুক্তদের নয়, বরং ‘অন্য’ ধরনের ব্যক্তিকেই দাসে পরিণত করত।
আফ্রিকার দাসপ্রথা
এদিকে, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্যের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলাম প্রথমে পশ্চিম আফ্রিকায় পৌঁছেছিল। তারা খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর প্রথম থেকেই এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল এবং এভাবে ধীরে ধীরে বাণিজ্যের হাত ধরে অত্যন্ত ধীর এবং শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে এই ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। বেশ কয়েক ধাপে উত্তর আফ্রিকার সাহারা জুড়ে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল।সমস্ত পণ্য মুসলিম ব্যবসায়ীদের একটি চেন মারফত পাঠানো হত এবং অবশেষে রুটের দক্ষিণ প্রান্তে অমুসলিমরা সেগুলি কিনে নিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত ঘানা রাজ্য উত্তরের মুসলিমদের সাথে ব্যবসার ক্ষেত্রে মূল অংশীদার ছিল।
পরবর্তী ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, পশ্চিম আফ্রিকার শাসক এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী যারা মুসলিম ব্যবসায়ীদের সাথে ব্যবসা করতে চাইত তারা ইসলাম এবং তার রীতিনীতির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। ইসলাম প্রত্যেক এলাকার স্থানীয় রীতিনীতির সাথে মিশ যেতে পারে সহজেই, এই কারণে রূপান্তরটি মসৃণ হয়েছিল। তবে পশ্চিম আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা অষ্টাদশ শতকের আগে পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি, এবং এই এলাকাই ট্রান্স-আটলান্টিক দাস ব্যবসার শীর্ষে ছিল।
পশ্চিমে দাস ব্যবসা ছড়িয়ে পড়া
বিদেশে দাস ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত, দাসপ্রথা আফ্রিকার ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে বিদেশে বিশেষত ইউরোপে দাস-প্রথা ছড়িয়ে পড়লে দাসের চাহিদা প্রচণ্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ দাস সংগ্রহ করার জন্য তখন যুদ্ধ, অভিযান এবং অপহরণের ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ইউরোপীয়রা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং আমেরিকায় তাদের মালিকানাধীন জমিতে আফ্রিকান দাসদের দিয়ে কাজ করাতে চাইত।
আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে হাজার হাজার মুসলমানকে বন্দী করা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাদের উত্তর আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তাদের ধর্ম বজায় রাখা কঠিন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসম্ভব ছিল। অনেককে জোর করে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল তারা ইসলামের রীতিনীতি মেনে চলার চেষ্টা করলে বা তাদের ঐতিহ্যবাহী নাম বা পোশাক পরতে চাইলে, সেই সমস্ত প্রচেষ্টা কঠোর ভাবে দমন করা হত। ফলে এগুলি তাদের গোপনে করতে হত।
মুসলিম দাসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা
তবে ইতিহাস জুড়ে মুসলিমদের উৎস সম্পর্কে প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়। হাতে লেখা বহু কুরআনের আয়াত পাওয়া গেছে এবং তার থেকে বোঝা যায় যে, দাসে পরিণত হওয়ার আগে এই ব্যক্তিরা আফ্রিকায় উচ্চ শিক্ষিত হয়েছিলেন। সেই আমলে যে বহু মুসলিম দাস ছিল, তা জানা যায় আর এক ভাবে, বহু পলাতক ক্রীতদাসের নাম নথিভুক্ত করা হত, এবং সেখানে বহু মুসলিমের নাম পাওয়া গেছে। আবার আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধে সেনাদের যে ডিউটি রোস্টার তৈরি করা হয়েছিল, সেখানেও বহু মুসলিমের নাম রয়েছে।
১৯৮৪ সালে ইতিহাসের বিশিষ্ট পন্ডিত ডঃ অ্যালান ডি অস্টিন একটি বই প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম ছিল “আফ্রিকান মুসলিমস ইন অ্যান্টেবেলাম আমেরিকা: আ সোর্স বুক”। এই বইয়ের বহু ছবি, নথি, মানচিত্র এবং টেক্সটের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, ১৭৩০ থেকে ১৮৬০-এর মধ্যে দাস হিসেবে আটকে পড়া ৫০ জন মুসলিম আফ্রিকানের জীবন। এই বইটি ১৯৯৭ সালে আপডেট করা হয় ও পুনঃপ্রকাশ করা হয়। তখন এর নাম দেওয়া হয়, “মুসলিমস ইন অ্যান্টেবেলাম আমেরিকা: ট্রান্সঅ্যাটল্যান্টিক স্টোরিজ অ্যান্ড স্পিরিচুয়াল স্ট্রাগলস”। দাস হিসেবে বন্দী হয়ে আমেরিকায় আসা কয়েকজন মুসলমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী বা স্ন্যাপশট এই বইয়ে রয়েছে।