আলেকজান্দ্রিয়া: রোমান থেকে মামলুক শাসনের সাক্ষী

ভূমধ্যসাগরীয় সমুদ্র উপকূলবর্তী প্রায় ২০ মাইল (৩২ কিমি) এলাকাজুড়ে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের অবস্থান। এখানেই রয়েছে আলেকজান্দ্রিয়ার নতুন লাইব্রেরি বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিনা। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে দিগ্বীজয়ী বীর আলেকজান্ডার এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর নামানুসারেই এই শহরের নামকরণ করা হয়েছিল। প্রাচীন যুগে, আলেকজান্দ্রিয়া ছিল বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত শহর। আলেকজান্দ্রিয়া বিখ্যাত ছিল তার প্রাচীন বাতিঘর এবং সেই সময়কার বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থাগারের জন্য।
আলেকজান্দ্রিয়ার ইতিহাস
ইতিহাসবিদ অ্যারিয়ানের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আলেকজান্ডার এই নগর পত্তন করার প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু তার সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের আগেই আলেকজান্ডার মিশর ছেড়ে পূর্বের দিকে চলে গিয়েছিলেন এবং কখনও এই শহরে ফিরে আসেননি।
আলেকজান্ডার চলে যাওয়ার পরে, তার ভাইসরয় ক্লিওমিনিস, এই নগরপত্তনের কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন।
আলেকজান্দ্রিয়া শুধুমাত্র হেলেনিজমের কেন্দ্র ছিল না, তৎকালীন বিশ্বে বৃহত্তম ইহুদি সম্প্রদায়ের বাসস্থান ছিল।
তবে আলেকজান্দ্রীয় গ্রীকরা বরাবর গ্রীক সংস্কৃতি থেকে অ-গ্রীকদের বাদ দেওয়ার ও তাদের পদানত করার উপরে জোর দিয়েছিল।
আলেকজান্দ্রিয়ায় ২টি প্রতিষ্ঠান ছিল যেগুলি সম্পূর্ণ গ্রীক সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং অধ্যয়নের জন্য নিবেদিত ছিল এবং সেখানে অ-গ্রীকদের কোনও স্থান ছিল না।
উল্লেখযোগ্যভাবে যে, আলেকজান্দ্রীয় কবিতাতেও মিশর বা স্থানীয় মিশরীয়দের কথার উল্লেখ খুব কম দেখা যায়; কিছু ক্ষেত্রে মিশরীয়দের উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের “দস্যু” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আলেকজান্দ্রিয়া ও রোমান ইতিহাসঃ
টলেমি আলেকজান্ডারের ইচ্ছানুসারে ৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেজান্দ্রিয়া শহরটি রোমানদের হাতে চলে যায়। তিনি ছিলেন টলেমি অষ্টম ফিজিকন এবং তৃতীয় ক্লিওপেট্রার পুত্র।
১১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাঁর ভাই টলেমি নবম লাথেরোসকে পদচ্যুত করেন তাঁর মা, এর পরে পরে তিনি নিজের মায়ের সহকারী হিসাবে রাজার পদ অধিকার করেন। তবে, ১০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি নবম টলেমি দ্বারা পদচ্যুত হন। এরপরে ১০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে টলেমি আলেকজান্ডার পুনরায় তাঁর মায়ের সহকারী হিসাবে রাজপদ অধিকার করেন। ১০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি নিজের মাকে হত্যা করে একচ্ছত্র শাসক হয়ে ওঠেন। তাঁর মৃত্যুর পরে নবম টলেমি সিংহাসন ফিরে পান।
একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই শহর রোমানদের অধীন ছিল। মার্ক অ্যান্টনি জুলিয়াস সিজারের পদাঙ্ক অনুসরণ করার ফলে এই শহর অক্টাভিয়ানের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়ায় অ্যান্টনির পরাজয়ের পরে অক্টাভিয়ান মিশরে অধিপত্য স্থাপন করেছিলেন।
এবং এমন একজনকে নিয়োগ করেছিলেন যিনি রোমান সেনেটের পরিবর্তে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর অধীনস্থ থাকবেন।
জানা যায়, আলেকজান্দ্রিয়ায় থাকাকালীন অক্টভিয়ান আলেকজান্ডারের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন।
এরপরে তাঁকে মিশরীয় ফ্যারাওদের সমাধিসৌধ পরিদর্শন করার প্রস্তাব দেওয়া হলে, তিনি তা অস্বীকার করে বলেছিলেন, ‘আমি একজন সম্রাটকে দেখতে এসেছি, লাশের সংগ্রহ দেখতে নয়’।
আলেকজান্দ্রিয়া ও মামলুক শাসনঃ
৬১৬ সালে, পারস্যের রাজা দ্বিতীয় খসরাউ এই শহর অধিগ্রহণ করেছিলেন। যদিও বাইজান্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস কয়েক বছর পরে এটি পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ৬৪১ সালে মিশরে মুসলিম বিজয়ের সময় আরবরা জেনারেল আমর বিন আল-আস (রা.) -এর নেতৃত্বে, ১৪ মাস এই শহর পুরোপুরি নিজেদের দখলে রেখেছিল।
৬৪৫ সালে বাইজেন্টাইন এই শহরটি পুনরায় দখল করে, তবে পরের বছর থেকে ফের এই শহরের উন্নতি শুরু হয়।
অনেকে দাবি করেন যে, আরব আগ্রাসনের সময় ৬৪২ সালে আলেকজান্দ্রিয়া বিখ্যাত গ্রন্থাগার এবং তার সমস্ত সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছিল।
অনেকে এই তথ্য অস্বীকার করে দাবি করেন যে, তৃতীয় শতকে রোমান সম্রাট অরেলিয়ানের আমলে গৃহযুদ্ধের জন্য গ্রন্থাগারটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
চতুর্দশ শতকে একটি ভূমিকম্পের জেরে বাতিঘরটি ধ্বংস হয়েছিল এবং ১৭০০ সাল নাগাদ এই শহর বলতে অবশিষ্ট ছিল ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ছোট্ট একটি নগর।
আলেকজান্দ্রিয়া ও নেপোলিয়নের অভিযানঃ
১৭৯৮ সালে মিশরে নেপোলিয়নের সামরিক অভিযানের সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া ফের আলোচনায় উঠে আসে। সেই সময়ে পিরামিডের যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী তৎকালীন মামলুক শাসকদের সমগ্র সেনাবাহিনী ধ্বংস করেছিল। এই অভিযানের তাৎক্ষণিক সামরিক উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের সাথে ব্রিটেনের যোগাযোগের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া।
আলেকজান্দ্রিয়ার কাছে নীল নদের যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনা ফরাসি নৌবহর ধ্বংস করে নেপোলিয়নের এই উদ্দেশ্য বিফল করার চেষ্টা করেছিল।
তবে বাকি ফরাসি বাহিনী তিন বছর যুদ্ধ করে মিশর দখল করেছিল। ১৮০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযান শেষ হয়।
কালের নিয়মে ধীরে ধীরে মিশরের উপরে ফরাসি নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে থাকে। এমন একটা সময় আসে যখন, মামলুক বংশ ক্ষমতাচ্যুত অথচ ফরাসি দখল শিথিল হতে শুরু করেছে, তখন মিশরে ক্ষমতাশূন্য অবস্থা তৈরি হয়।
তখন এক তরুণ অফিসার, মহম্মদ আলিকে মিশর থেকে ফরাসিদের বিতারণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
মহম্মদ আলী কায়রোর গ্রামে নেতা, উলেমা ও ধনী ব্যবসায়ীদের স্থানীয় শক্তি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতাশূন্য অবস্থা পূরণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
এর পরে তাঁকে সেখানকার ভাইসরয় হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
মহম্মদ আলীর শিল্পায়ন কর্মসূচির অংশ হিসাবে আলেকজান্দ্রিয়া শহরের পুনরুত্থান হয়েছিল।
তিনি শহরটি পুনর্নির্মাণ করার কাজ শুরু করেছিলেন ১৮১০ সালের গোড়ার দিকে, এবং ১৮৫০ সালের মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়া তার হৃত গৌরব অনেকাংশে পুনরুদ্ধার করেছিল।