ইসলামী খিলাফতের প্রাচীন রাজধানী ও জ্ঞানের নগরী কুফা

ইসলামের আহ্বান বিশ্বব্যাপী ছড়ানোর সময় কুফা শহর ছিল এই বিশাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। এই শহরেই কার্যত মিলিত হয়েছিল বিশ্বের সকল জ্ঞান এবং জ্ঞানী পন্ডিতরা। এই কুফাকে নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, বহু লেখক ও দার্শনিক নিজের ভাবনা ও মতাদর্শ দিয়ে কুফা শহরের তৎকালীন অবস্থার কথা বিশ্লেষণ করেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ যাকে কুফা শহরের বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপিডিয়া বলা হয় তা হলো আ‘লমকুফা। গ্রন্থের রচয়িতা ইরাকের ঐতিহাসিক সায়িদ মুদার আল হুল, সেই সপ্তম শতকের শুরুর সময় থেকে বিংশ শতকের উসমানীয় রাজত্ব পর্যন্ত এক বিশাল বিস্তৃত সময়কালকে গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। ইসলামী বিশ্বে কুফার বিশেষ তাৎপর্য্য ছিল।
ইসলামী বিশ্বে কুফার গুরুত্বঃ
সেই অষ্টম শতকে কুফা শহরের গৌরব, খ্যাতি ও গুরুত্বকে সংক্ষেপে প্রকাশ করতে গিয়ে দার্শনিক আয়ুব বিন আল–মুতাওয়াক্কিল বলেন, “যে ব্যক্তি কুফায় আসেনি এবং ইউফ্রেটিসের পানি পান করেনি, সে পবিত্র কোরআনও পড়েনি।“
ইউরোপের মাটিতে নবজাগরণ শুরু হওয়ার প্রায় পাঁচশ বছর আগে কুফা দেখেছিল যুক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান, বিচার, বিশ্লেষণ এবং গবেষণার সমন্বয়ে কী ঘটতে পারে।
বিশ্বের বহু প্রান্ত থেকে দার্শনিক গবেষকরা এসে সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন এক একটা জ্ঞানের ভান্ডার।
ইসলামী বিশ্বে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল বহু পুরোনো বিশ্বাস এবং জন্ম নিয়েছিল নতুন বিতর্ক।
এই সমস্ত কিছুই শুরু হয়েছিল প্রিয়নবী মুহম্মদ (সাঃ)-এর ৩৭০ জন সাহাবী সপ্তম শতকে কুফায় আসার পরে। এই সময় থেকে কুফায় জনসমাগম বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
বহু দার্শনিক, ঐতিহাসিক, কবি–সাহিত্যিক এবং গবেষকরা আসতে শুরু করেন কুফা শহরে।
এত জ্ঞানী ব্যক্তিত্বের সমাগমে প্রভূত উন্নতি লাভ করে আরবি ভাষা, বিশেষ করে আরবির রূপতত্ব ও ব্যকরণগত বিষয়গুলি এই সময় অনেক উন্নতি করে।
এছাড়া ইসলামি আইনবিদ্যা এবং ভাবধারা আরও বেশি সংগঠিত হয়, দর্শন, কবিতা, শিল্প–সংস্কৃতি এবং ডাক্তারি ও রসায়নশাস্ত্রে কুফা পৃথিবীকে পথ দেখাতে শুরু করে।
কুফার পত্তনঃ
হযরত উমর রা. এর খিলাফতের সময় যখন কুফানগরীর গোড়াপত্তন হল তখন সে শহরের কুরআন-সুন্নাহর মুআল্লিম হিসেবে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.কেই নির্বাচন করেছিলেন এবং কুফার অধীবাসীদের উদ্দেশ্য করে ফরমান লিখেছিলেন, ‘আমি আম্মার রা.কে আমীর বানিয়ে এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.কে উযীর ও মুআল্লিম বানিয়ে তোমাদের কাছে প্রেরণ করছি।
তাঁরা দুজনই বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন এবং তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদাপূর্ণ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।
তাদের অনুগত থাকবে এবং তাদের অনুসরণ করবে।
আব্দুল্লাহকে আমার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু আমার প্রয়োজনের উপর আমি তোমাদের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিলাম।’
কুফা নগরীতে এসে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. জ্ঞানের যে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করেছেন এবং তাঁর উত্তরসুরীরূপে এমন এমন ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছেন যার তুলনা সে সময়েও খুব বেশি ছিল না।
কুফা নগরীর আরো সৌভাগ্য যে, হযরত আলী রা.-এর খিলাফতের সময় তা ছিল ‘দারুল খিলাফাহ’ অর্থাৎ রাজধানী।
আর আলী রা. সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ‘তিনি হলেন জ্ঞাননগরীর দ্বার।’ তাই তাঁর আগমন ইলমের কেন্দ্ররূপে এ নগরীকে আরো সমৃদ্ধ করেছিল।
তবে এ নগরীতে কুরআন-সুন্নাহর ইলমের সূচনা ও বিকাশ যেসব সাহাবীদের মাধ্যমে হয়েছে তাদের মধ্যে শীর্ষ স্থানে ছিলেন হযরত অব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.।
কুফাবাসীদের জ্ঞান অন্বেষণের জন্য অন্যান্য সাহাবীও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর অবস্থানকেই যথেষ্ট মনে করতেন।
ইসলামী বিশ্বে কুফার আলিমগণের অভ্যাস ছিল তারা অন্যান্য কেন্দ্রে সফর করে জ্ঞান-ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতেন।
শিল্প- সংস্কৃতির পীঠস্থানঃ
শিল্প–সংস্কৃতির পীঠস্থান হওয়ার পাশাপাশি কুফা শহর ছিল বিকল্প ভাবনার প্রধান স্থান। পৃথিবী যখন তার চিরাচরিত নিয়মে চলছে এবং ভিন্ন মতামত সাধারণভাবে প্রাণঘাতী ছিল তখন কুফার সীমানার ভিতরে মানুষ অনেক বেশি মুক্তি অনুভব করত।
এখানে ভাবার স্বাধীনতা ছিল, তাই পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের মানুষরা সেই চিরাচরিত ভাবনাগুলিকে খন্ডাতে পারত এবং নতুন ভাবনা এনে উপস্থিত করত।
এই অগ্রগামী মনোভাব ইউরোপে পা ফেলেছিল বহু শতাব্দি পরে।
কদাচিৎ শাসকেরা রাশ টানার চেষ্টা করলেও, দার্শনিক ও চিন্তকদের মাসোহারা বা অন্যান্য অর্থনৈতিক সামাজিক সাহায্য, জাতি–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে দেওয়া হতো।
বর্তমান গোঁড়া ইসলামিক দেশগুলির মতো কুফা কুসংস্কার বা ধর্মীয় পরিচয়কে মোটেই গুরুত্ব দেয়নি।
এখানে মুতাজিলারা যে স্থান পেয়েছিল, ইহুদি বা খ্রীস্টানরাও একই স্থানের অধিকারী হয়েছিল।
এমনকি কুফার উন্নতির চরম সময়ে অজ্ঞেয়বাদীদের (যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত কিন্তু নাস্তিক নয়) সংখ্যা চোখে পরার মতো ছিল।
এই বৈচিত্রময় সংস্কৃতি কুফার রাজনৈতিক উত্থান–পতনের সাথে সম্পর্কিত ছিল না।
কুফা যখন রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্ব হারাতে শুরু করে বাগদাদ, কায়রো, কনস্ট্যান্টিনোপেল, করডোবার মতো শহরগুলির কাছে তখনও এই জ্ঞানের পীঠস্থানের জনপ্রিয়তা কমে যায়। ইসলামী ভাবনায় কুফা ছিল অমলিন।
ইসলামী ভাবনায় আ’লমকুফার গুরুত্বঃ
আ‘লমকুফা গ্রন্থটি নটি খন্ডে বিভক্ত, এর প্রতিটি খন্ড কুফার ইতিহাসকে খুঁড়ে বের করেছে এবং বিশ্লেষণ করেছে। প্রধানত সেই সময়ের প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জীবন ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করেছেন লেখক।
কুফার রাজনৈতিক ইতিহাসের উপর লেখা বইয়ের কোনো অভাব নেই আজ কিন্তু তার সংস্কৃতি ও জ্ঞানভান্ডার হয়ে ওঠার কাহিনী অনেকই এড়িয়ে যান।
আ‘লমকুফা এই সমস্যার সমাধান করেন এবং নয়টি খন্ডকে প্রধানত রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ে বিভক্ত করেন।
গ্রন্থটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে সর্বধর্মের মানুষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুযায়ী সমান স্থান পেয়েছে। বহু খ্রীস্টান কবি এবং বিজ্ঞ নারীদের প্রতি লেখক বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বিশ্বকোষসম এই গ্রন্থ ৭০ জন ইমাম, নবী মুহম্মদ (সাঃ)-এর ৪৬২ জন অনুগামী, তাঁদের ৯৯৭ জন ছাত্র, ৬৭৩৪ জন পন্ডিত, ১১ জন কোরআন বিশেষজ্ঞ, ১১ জন ঐতিহাসিক, ৮৫২ জন লেখক, ৩৮৪০ জন কবি, ৮০ জন ভাষাবিদ, পাঁচ জন ডাক্তার, ২৭ জন সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার, ১৬৭১ জন খলিফা ও শাসক এবং ৭৫০ জন বিচারকের জীবনের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।