ইসলামের দৃষ্টিতে ধনী হওয়া কি খারাপ? (৩য় পর্ব)

২য় পর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, কিভাবে ধনীরা দরিদ্রদের চেয়ে আর্থিকভাবে কিছু আমল বেশি করার সুযোগ পেয়ে থাকে এবং এসকল আমলের মধ্যে ফরজ আমলগুলিতে ঘাটতি করলে আল্লাহ কিভাবে তাদেরকে শাস্তির ধমকি দিয়েছেন। পূর্বের ২টি পর্ব থেকে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, ধনী হওয়া মূলত আল্লাহর অশেষ হিকমতেরই একটি অংশ এবং এটি আল্লাহর অশেষ নি’আমতও বটে। এই পর্বে আমরা ইসলামের ইতিহাসে কিছু ধনী সাহাবীদের নিয়ে আলোচনা করব। যাদের আমল এটা প্রমাণ করবে যে, ধনী হওয়া মুলত ইসলামের দৃষ্টিতে খারাপ নয়। বরং এটি একটি নি’আমত। তবে এই নি’আমতের যথাযথ শুকরিয়া আদায় করতে না পারলে তার জন্য আখিরাতে লাঞ্চনা ও শাস্তির শিকারও হতে হবে।
সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেমন ধনী ছিলেন আর তারা আল্লাহর রাস্তায় বা দ্বীনী কাজে কিভাবে খরচ করতেন তার কিছু নমুনা নিম্নে উল্লেখ করা হল
ইবনে উমার(রাযিঃ) বলেন, ইসলাম গ্রহণের সময় হযরত আবু বকর(রাযিঃ) এর নিকট চল্লিশ হাজার দিরহাম ছিল। (দিরহামের বর্তমান বাজার মূল্য ১৩৯ টাকা হিসেবে যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫৫,৬০,০০০ টাকার সমপরিমাণ)। আর হিজরতের সময় তার নিকট ৫ হাজার দিরহামের বেশি ছিল না। বাকি সব সম্পদ তিনি ইসলামের সাহায্যে এবং মুসলমান গোলাম ক্রয় করে আযাদ করার পেছনে ব্যয় করেছিলেন। অর্থাৎ হিজরতের পূর্বেই বর্তমান বাজারমূল্য হিসেবে তিনি প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ইসলামের জন্য ব্যয় করেছিলেন। সুবহানাল্লাহ!
রুমা নামক একটি কূপ মদিনায় সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল। উসমান(রাযিঃ) তা ৩৫ হাজার দিরহাম অর্থাৎ ৪৮ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকার বিনিময়ে কিনে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
তালহা (রাযিঃ) উসমান(রাযিঃ) থেকে ৫০ হাজার দিরহাম অর্থাৎ প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা ধার করেছিলেন; যা পরে উসমান (রাযিঃ) মাফ করে দিয়েছিলেন!
তাবুকের যুদ্ধে উসমান(রাযিঃ) তার সম্পদের ৩ ভাগের ১ ভাগ দান করে দিয়েছিলেন। ৯৪০টি উট ও ৬০টি ঘোড়ার পাশাপাশি তিনি আরও ১০ হাজার দিনার দান করেছিলেন। (১ দিনার এর স্বর্ণের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৫,৩৩০ টাকা)। সুতরাং, ১০ হাজার দিনার বর্তমান বাজারদর হিসেবে প্রায় ১৫ কোটি ৩৩ লক্ষ টাকা!
সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী সাহাবী ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ(রাযিঃ)। তিনিও তাবুক যুদ্ধে ৮ হাজার দিনার দান করেন। অর্থাৎ প্রায় ১২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা। এছাড়াও তিনি তার একটি জমি চল্লিশ হাজার দিনারে অর্থাৎ প্রায় ৬১ কোটি টাকার বিনিময়ে বিক্রয় করেন এবং সম্পূর্ণ অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেন।
এছাড়াও তিনি চল্লিশ হাজার দিরহাম অর্থাৎ ৫৬ লক্ষ টাকা, মুজাহিদদের জন্য ৫০০ টি ঘোড়া এবং ১৫০০ টি উট দান করেছিলেন। জীবিত সকল বদরি সাহাবী এবং উম্মুল মু’মিনীনদের জন্য তিনি চারশত দিনার অর্থাৎ প্রায় ৬২ লক্ষ টাকা করে হাদিয়া দিয়েছিলেন।
দানশীলতা ও বদান্যতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ
এগুলি হল ইতিহাসে পাওয়া সাহাবীদের প্রকাশ্যে দানশীলতার কিছু উদাহরণ আর তাদের গোপনে দান করা সম্পদের পরিমাণ কত ছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন।
একটু চিন্তা করুন, যারা এই পরিমাণ দান করেছেন তাদের সম্পদের পরিমাণ না জানি কত ছিল। কিন্তু এত সম্পদ তাদেরকে আল্লাহ থেকে বিমুখ করতে পারে নি। অকাতরে সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে তারা আল্লাহর অপার সন্তুষ্টি অর্জন করে নিয়েছেন।
এই হল ইসলামের ইতিহাসে কিছি ধনাঢ্য ব্যক্তি ও তাদের দানশীলতার কিছু উদাহরণ। সুতরাং, এ থেকে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, শুধু ধন-সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ দেখলে হবে না; বরং, তাদের দানশীলতা ও বদান্যতার পরিমাণটাও আমাদেরকে দেখতে হবে। তারা যেভাবে সঠিকভাবে সম্পদের হক আদায় করেছেন, আমরা যদি তা না করতে পারি তবে তা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহর আজাবের মুখোমুখি হতে হবে।
এ কারণেই সকল যুগের অধিকাংশ ইসলামিক স্কলাররা ধনী হওয়ার জন্য মূলত উৎসাহ দেন না। কারণ, এটি এমন একটি নি’আমত অধিকাংশ মানুষই যার হক আদায় করতে পারে না। আর তা আখিরাতে ধ্বংস ডেকে আনে। এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামও বলেছেন, “দরিদ্ররা ধনীদের ৫০০ বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। সুতরাং, সকল বিষয় সামনে রেখে আমাদের উচিত আল্লাহর নিকট এই দু’আ করা যে, “হে আল্লাহ! আমার জন্য যা কল্যাণকর আমাকে তা দান করুন।” আর আল্লাহ আমাদেরকে যে অবস্থায় রেখেছেন সেই অবস্থাতেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা।