‘ঈশ্বরের ধর্ম’ কেন ও কীভাবে বিলুপ্ত হল?

দ্বীন-ই-ইলাহি অর্থাৎ ঈশ্বরের ধর্ম প্রবর্তক মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় তথা সর্বশ্রেষ্ট শাসক জালালউদ্দীন আকবর। মুক্তমনা সম্রাটের কাছে সব ধর্মই একটি আগ্রহের বিষয় ছিল। বিভিন্ন ধর্মের এই যে বৈচিত্র্য, তা আকবর বিভিন্ন রকম পরীক্ষানিরীক্ষার বিষয়বস্তু হিসাবে দেখেন। সেরকমই পরীক্ষানিরীক্ষার একটি ফসল দ্বীন-ই-ইলাহি। ঈশ্বরের ধর্ম তাকে বাংলায় বলা হয়।
কী এই দ্বীন-ই-ইলাহি বা ঈশ্বরের ধর্ম?
ইসলাম, হিন্দু ধর্ম, পার্সী, জৈন ও খ্রীস্টান, সম্রাট আকবরের সময় ভারতে এই ধর্মগুলির প্রাধান্য ছিল। এদের মধ্যে ইসলাম সেই সময় ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী কারণ মুঘল সাম্রাজ্য ইসলামিক পথে চালিত হতো। স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দুপ্রধান দেশে ইসলামের আধিপত্য একটা চাপানউতোর সৃষ্টি করেই রেখেছিল। কিন্তু দোর্দন্ডপ্রতাপ বাদশারা একে নিয়ন্ত্রণ করতে কার্পণ্য করেননি। সম্রাট আকবর পরিকল্পনা করেন এমন এক ধর্ম যা প্রত্যেক ধর্মের কিছু ভালো দিক নিয়ে তৈরি হবে। তাই তিনি তৈরি করলেন দ্বীন-ই-ইলাহি। তৎকালীন সময়ে সহনশীলতার উত্তম উদ্ধাহরণ ছিলেন সম্রাট আকবর।
বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ইসলাম থেকে আকবর নিয়েছিলেন ঈশ্বরের ধারণা, খ্রীস্টানদের থেকে নিয়েছিলেন পবিত্রতার তত্ত্ব, জৈনদের মতো পশুহত্যার নিষিদ্ধ করেছিলেন, পার্সীদের থেকে আগুন বা সূর্যের উপাসনা করা শুরু করেছিলেন তিনি।
দ্বীন-ই-ইলাহিকে একটি ধর্ম না বলে রাজনীতির ধর্মীয়করণ বলা যেতে পারে। আকবরের উদ্দেশ্য ছিল এই বহু ভাষাধর্মের দেশে এমন একটা ধর্ম যা মানুষকে একতাবদ্ধ করতে সাহায্য করবে। উত্তরের রাজপুতরা সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল মুঘলদের, তাদের সন্তুষ্ট রাখার প্রয়াস হিসেবেও এটাকে দেখা যেতে পারে।
সম্রাট আকবরের বিভিন্ন ধর্মের প্রতি অনুরাগ প্রথম থেকেই ছিল। তাঁর এই কৌতুহলের জন্য ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন একটি ইবাদতখানা, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুরা আসতেন ধর্মবিষয়ক আলোচনা করতে। এই আলোচনা সভা যদিও পরের দিকে হয়ে ওঠে অন্যের ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করার সভা। প্রত্যেকে নিজের ধর্মকেই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণিত করতে উঠেপড়ে লাগায় সম্রাট আকবর বাধ্য হয়ে ১৫৮২ এটি বন্ধ করে দেন।
দ্বীন-ই-ইলাহি কি ইসলামবিরুদ্ধ?
এই প্রশ্নের এককথায় উত্তর হ্যাঁ। সম্রাট আকবর যদিও এই ধর্মের বিষয়ে নিজের অবস্থান বা ভবিষ্যতপরিকল্পনা কোনোটাই সুস্পষ্ট করেননি তাও এই ধর্ম যে ইসলামের বেশ কিছু নিয়ম ও সীমাকে লঙ্ঘন করে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ইসলাম অনুযায়ী ঈশ্বরের কোনো প্রতীক হয় না, সমস্ত প্রার্থনা একমাত্র ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই করা উচিত। কিন্তু এই ধর্মে সূর্যের উপাসনা করার চল ছিল এমনকি সূর্য প্রণামের মতো রীতিও প্রচলিত করেছিলেন সম্রাট আকবর। মদ্যপান বা জুয়া খেলার মতো বিষয়ে এই ধর্মে অবাধ ছাড় ছিল যা কঠোরভাবে ইসলাম বিরুদ্ধ।
মুসলমানদের আসসালামো আলায়কুম বলে একে অপরকে সম্ভাষণ করার পদ্ধতি তুলে দেন আকবর। তার বদলে বলা হতো “আল্লাহু আকবর” এর উত্তরে বলতে হলো “জাল্লা জালালুহু” অর্থাৎ “সম্রাট মহান”। এ বিষয়ে আর একটি বিতর্ক আছে “আল্লাহু আকবর” শব্দটি নিয়ে। এর আক্ষরিক অর্থ “আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ট” কিন্তু অনেকে এর অর্থ অনুধাবন করেছিলেন “আকবর মহান” বলে। এছাড়াও আকবর সেই সময়ের কলমা মুদ্রিত মুদ্রার জায়গায় “আল্লাহু আকবর” মুদ্রিত করেন। যদিও সম্রাট আকবর কোনোদিনই নিজেকে সর্বেসর্বা বলে ঘোষণা করেননি। তাঁর এই অস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে বিতর্কও কম কিছু হয়নি।
দ্বীন-ই-ইলাহি কত জনপ্রিয় ছিল?
আকবরের এই নতুন ধর্ম পনেরো থেকে কুড়ি জনের মধ্যেই সীমিত ছিল। কেউই নিজধর্ম ত্যাগ করে এরকম আনকোরা এক ধর্মে আসতে চায়নি। যাঁরা এই ধর্মগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে একমাত্র বীরবল ছিলেন হিন্দু বাকি সবাই মুসলমান ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এই ধর্মগ্রহণকারীদের মধ্যে কেউ স্বেচ্ছায় করেননি, বাদশার সুনজরে থাকাই ছিল তাদের লক্ষ্য। আকবরের মৃত্যুর পর এই ধর্মও চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীরও এই ধর্মের বিরোধিতা করেন। বাদশাহের নিজের সৃষ্ট ধর্ম তাঁর সাথেই বিলুপ্ত হয়ে গেল।