উনিশ শতকের আগে জাপানে ইসলামের প্রসার কীভাবে হয়েছিল?

উনবিংশ শতকের আগে এশিয়ার বেশিরভাগ দেশই ইউরোপের কলোনি হিসাবে পরিচিত ছিল, মাত্র দু’খানি দেশ ছিল শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে স্বাধীন। এই দেশগুলির একটি ছিল অটোমান সাম্রাজ্য ও দ্বিতীয়টি ছিল জাপান। এখন শ্বেতাঙ্গদের সাম্রাজ্যবিস্তারের করাল গ্রাস থেকে নিজেদের বাঁচাতে এই দুটি দেশ সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করবে। এই সম্পর্কের খাতিরেই এক দেশ থেকে আরকদেশে বন্ধুত্বপূর্ণ আদানপ্রদান শুরু হয়। এই আদানপ্রদানের মধ্যে এক দেশে আরেকদেশের প্রতিনিধি পাঠানো ছিল অন্তত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাচ্য ও পশ্চিমের বন্ধুত্ব
তৎকালীন তুরস্কের শাসক দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ( শাসনকাল ১৮৭৬-১৯০৯) ১৮৯০ খৃস্টাব্দে এরতুগ্রুল নামক একটি জাহাজে ৬০০ উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও সৈনিক পাঠান জাপানে। এই যাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অ্যাডমিরাল উসমান পাশা। সেখানে জাপানিরা তাদের অত্যন্ত আদর যত্ন করে। তৎকালীন জাপানি সম্রাট তাদের অত্যন্ত খাতির করেন ও দুইদেশের মধ্যে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর হয়। তবে, জাপান থেকে ফেরার সময় ভয়াবহ টাইফুন ঝড়ে তাঁদের জাহাজডুবি হয়, ৫৫০ জন মারা যান। যার মধ্যে সুলতান আবদুল হামিদের ভাইও ছিলেন।
এই দুর্ঘটনায় দুইদেশের শাসকই অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন, যারা জাহাজডুবিতে বেঁচে গিয়েছিল, তাড়াতাড়ি তাদের অন্য জাপানি জাহাজে করে ইস্তানবুলে নিয়ে যাওয়া হয়। জাহাজডুবি যেখানে হয়েছিল সেখানকার কাছের অঞ্চলে উদ্ধার করা দেহগুলি যথোপযুক্ত সম্মান সহযোগে সমাধি দেওয়া হয় ও সেখান একটি মেমোরিয়াল মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়। আজও জাপানি ও তুর্কীরা পাঁচ বছর অন্তর অন্তর ঐ মর্মান্তিক ঘটনার কথা মনে করেন ও ঐ মেমোরিয়ালে নানাবিধ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মান জ্ঞাপন করেন।
প্রথম জাপানী মুসলমান
যে জাহাজে করে বেঁচে যাওয়া লোকজনে তুরস্কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই জাহাজেই ছিল তোরাজিরো নোদা নামে এক কমবয়েসি সাংবাদিক। তিনি জাপান থেকে শহিদদের পরিবারের জন্য কিছু উপঢৌকন নিয়ে যাচ্ছিলেন ইস্তানবুল। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ তাঁকে অনুরোধ করেন তুরস্কে থেকে যেতে ও তাঁর উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের জাপানি ভাষার শিক্ষা প্রদান করতে। তোরাজিরো তাতে রাজি হন। ইস্তানবুলে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় আবদুল্লাহ গিলামির, যিনি আদতে ব্রিটেনের লিভারপুলের বসবাস করলেও তুরস্কের প্রতি ছিল তাঁর নাড়ির টান। তিনিই তোরাজিরোকে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলেন। তোরাজিরো গিলামির সঙ্গে ইসলাম নিয়ে প্রভূত আলোচনা করেন। দিনের পর দিন আলোচনা করে তবেই তিনি রাজি হন ইসলাম নিতে। সত্যি কথা বলতে কী, তিনি বুঝতে পারেন ইসলাম ধর্মের মর্ম ও মূল্য। মুসলমান হওয়ার পর তাঁর নাম হয় আবদুল হালিম, তুরস্কের প্রাচীন বই পত্র থেকে এই নামই পাওয়া যায়।
এই আবদুল হালিমকেই বলা হয় প্রথম জাপানি মুসলমান। এর কয়েক বছর পরে, ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইয়ামাদা নামক আরেক জাপানি যুবক ইস্তানবুল শহরে পা রাখেন। তিনিও জাপান থেকে শহিদদের পরিবারের সাহায্যকল্পে কিছু অর্থ নিয়ে গিয়েছিলেন। তোরাজিরোর সঙ্গে তাঁর দেখা হয় ও তিনি চমৎকৃত হন তাঁর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কথা শুনে। তারপর তিনিও ইসলাম ধর্ম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর নাম হয় খলিল বা আবদুল খলিল। তিনি ইস্তানবুলে নিজের ব্যবসা পত্তন করেন এবং সেখানকার নাগরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। অতঃপর জাপানে ফিরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সংস্কৃতির বিকাশ
তৃতীয় যে ব্যক্তি জাপানে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি আগে ধর্মে খ্রিস্টান ছিলেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে এসেছিলেন, বোম্বে শহরের অপূর্ব সুন্দর মসজিদটি দেখে তিনি আকৃষ্ট হন। তারপর তিনি ইস্তানবুলে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর নাম হয় আহমেদ আরিগা।
এই সময় থেকেই ইস্তানবুল ও ভারত থেকে বেশ কিছু মুসলমান ব্যবসায়ী টোকিও, ইয়োকোহামা ও কোবে শহরে বসবাস করতে শুরু করলে জাপানে মুসলমান সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসার হতে শুরু করে।
জাপান ও তুরস্কের সুসম্পর্ক এখনও বজায় রয়েছে।