এক নও-মুসলিমের চোখে মহররম মাস

মহররম মাসের আগ দিয়ে আমার সহোদর বোনেরা কী নিয়ে আলোচনা করছেন সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তবুও, আমার প্রাথমিক পড়াশুনা থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কারবালার শোকাহত ঘটানাটি মহররম মাসে ঘটেছিল।
আমি সন্ধ্যায় দ্বীনি মজলিসগুলিতে অংশ নিতে শুরু করি, যেখানে আমি প্রতি সন্ধ্যায় অনেক নতুন বিষয় জানতে থাকি।
বাসা ছেড়ে মজলিসে যাওয়ার পথে আমি প্রায়ই কাঁদতে শুরু করতাম। আমার সহানুভূতির স্তরটি প্রায় শূন্য থেকে দশে উঠে গেছিল।
অশ্রুসিক্ত মহররম
২০১২ সালের নভেম্বর মাসে যখন মহররম আসে তখন প্রথমবারের মত আমার অশ্রুসিক্ত হয়েছিল। এর আগে খ্রিষ্টান অবস্থায় আমার উপর কখনও এমন অবস্থা আসেনি। যিশুর জন্য আমি কখনও অশ্রু ফেলিনি।
কিন্তু আমি দেখলাম মুসলমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’আইহি ওয়া সাল্লাম এর নাতি হোসাইন (রাযিঃ) এর জন্য প্রতি মহররমে কারবলার কথা স্মরণ করে শোক প্রকাশ করে। তাঁর কবর জিয়ারত করে। পানি পান করার সময় হোসাইন (রাযিঃ) এর তৃষ্ণার কথা তারা স্মরণ করে।
এই অশ্রুগুলি আমাকে উপলব্ধি করিয়েছিল যে, আমি কিভাবে একটি নম্র সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছি। তদুপরি, আমার অশ্রু আমাকে আশ্বস্ত করেছিল যে, আমি সঠিক ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বেছে নিয়েছি।
রাত দশটা পার হয়ে গেল। তখন আমি আয়োজকদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, আমরা কি পরের বছর এটি আবার পালন করব? তিনি জবাব দিলেন “চল্লিশ দিন না হওয়া পর্যন্ত আমরা কালো পোশাকগুলি খুলব না”।
আমি আরবাইন (চল্লিশ দিন) সম্পর্কে পড়াশোনা করে জানতে পারলাম যে কারবালার উত্তপ্ত জ্বলন্ত বালির উপর হোসাইন (রাযিঃ) এর শাহাদতের চল্লিশ দিন পর্যন্ত চিহ্নিত ছিল। কারবালার শোকাহত ঘটনার পরে নারী ও শিশুদেরকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাদেরকে ইরাকের কুফায় জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কুফার গভর্নর ইবনে জিয়াদের সৈন্যদের ধরে রাখা বর্শার উপরে তাদের প্রিয়জনের কাটা মাথার সামনে লাইন ধরে তাদেরকে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
ইয়াজিদের হাতে নবী পরিবারের হেনস্থা
হোসাইন (রাযিঃ) এর পুত্র আলী অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে হোসাইন (রাযিঃ) তাঁর বোন জয়নাব (রাযিঃ) কে ইসলামের পতাকা বহন করতে দিয়েছিলেন। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, জয়নাব (রাযিঃ) কে অবিচ্ছিন্নভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল, তবুও তিনি মর্যাদার সাথে পতাকা ধরে রেখেছিলেন। একবার ইয়াজিদ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলঃ “আল্লাহ আপনার ভাই এবং পরিবারের সাথে যেভাবে আচরণ করলেন, তা আপনি কিভাবে দেখছেন?” তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, “আমি সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই দেখছি না”।
তাদেরকে শামে (যেটিকে আধুনিক দিনে দামেস্ক বলা হয়) নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ নবী পরিবারের এই সদস্যদেরকে বিভিন্নভাবে উপহাস করছিল। তখন সাথে সাথে জয়নাব (রাযিঃ) জবাব দিয়েছিলেনঃ “তুমি কি মনে করছ যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাতিকে হত্যা করে এবং আমাদেরকে বন্দী হিসাবে তোমার প্রাসাদে নিয়ে এসে ইসলামের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে ফেলেছ?”
শামে জয়নাব (রাযিঃ) এর বন্দিদশার সময় সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় ছল, তিনি কারবালার শহীদদের স্মরণে প্রথম মজলিস আয়োজন করেছিলেন।
দামেস্কের মহিলারা তাঁর কাছে সমবেত হত এবং তিনি ও বন্দী অন্যান্য মহিলারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা তাদেরকে জানাত যে, শহীদদেরকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তাদেরকে কীভাবে পানীয় থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল, ছোট বাচ্চারা কীভাবে পানির জন্য কেঁদেছিল, বাচ্চা আলী আসগর কীভাবে মারা গেছিল ইত্যাদি এই মজলিসে সাত দিন ধরে আলোচনা হয়েছিল।
অবশেষে এই কাফেলাটিকে মদীনায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে তাদেরকে কারবালার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যেখানে তাদের আত্মীয়স্বজন এবং প্রিয়জনদের লাশ আশেপাশের গ্রামের লোকেরা সমাহিত করেছিল।
চল্লিশ দিনের শোক
এখান থেকেই তাঁর পক্ষ থেকে সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাকে প্রশংসা করে এবং তার গুণাবলীকে আলোচনা করে মৃত্যুর পরে চল্লিশ দিন মৃত ব্যক্তির জন্য শ্রদ্ধা জানার রেওয়াজ শুরু রয়েছে।
কিছু খ্রিস্টান তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর চল্লিশ দিন পরে শোকের অনুষ্ঠান করে। তারা একটি গির্জায় জড়ো হয় এবং একটি বিশেষ প্রার্থনার পুনরাবৃত্তি করে থাকে। তারা একইভাবে কারও মৃত্যুর ছয় মাস পরে এবং এক বছর পরেও এমনটি করে থাকে।
ইহুদিরা প্রিয়জনের মৃত্যুর ত্রিশ দিন পরে শোকের অনুষ্ঠান করে থাকে। একইভাবে নয় মাস পরে আবার এক বছর পরে অনুষ্ঠান করে থাকে।
সুতরাং, হোসাইন (রাযিঃ) এর শাহাদাত বার্ষিকীর চল্লিশ দিন পর তাঁকে স্মরণ করার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই প্রচেষ্টা করতে হবে, কারণ এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পাঠকে প্রতিফলিত ও প্রয়োগ করার পথকে সুগম করবে।