এশিয়ার সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন কোন নবাব?

গ্রন্থাগারের গোড়াপত্তন
মুসলিম বিশ্বের মধ্যে পারস্য প্রথম অষ্টম শতাব্দীতে কাগজ তৈরির শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছিল। তার পরে মুসলমানরাই ভারত এবং ইউরোপে কাগজ তৈরির শিল্পের প্রচলন ঘটিয়েছিল। বাগদাদ, কায়রো এবং কর্ডোবায় পাবলিক গ্রন্থাগার নির্মীত হয়েছিল, যেখানে কাগজ দিয়ে তৈরি বইগুলি রাখা থাকত। খোদাই করা ছবি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে, ইসলামিক বইগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল ক্যালিগ্রাফি।
বিশ্বে জনসাধারণের জন্য পাবলিক গ্রন্থাগার প্রথম চালু করেছিল গ্রীকরা। গ্রন্থাগারগুলিকে শিক্ষকদের শিক্ষক হিসাবে বিবেচনা করা হত। লাইব্রেরি শব্দটি এসেছে ল্যাটিল শব্দ লিবার থেকে, যার অর্থ গ্রন্থ। আবার জার্মান ও রোমান্স ভাষাগোষ্ঠীতে গ্রন্থাগার অর্থে ব্যবহার করা হত গ্রীক শব্দ বিব্লিওথেকা।
মুসলিম বিশ্বের পাবলিক গ্রন্থাগারগুলি বিভিন্ন রকম নামে পরিচিত ছিল, যেমন বায়তুল হিকমাহ, খিজানাত আল-হিকমাহ, বা দার আল-হিকমাহ, বা দার-আল-‘ইলম, দার-আল-কুতুব, খিজানাত আল-কুতুব এবং বায়তুল-কুতুব, কিতাব-খানা (ইরান), কুতুফানে (তুরস্ক)। সেই সময় মাদ্রাসা গ্রন্থাগার, সরকারী ও বেসরকারী গ্রন্থাগার, প্রাসাদের গ্রন্থাগার, ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি এবং হাসপাতালের সাথে সংযুক্ত গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব ছিল।
মধ্যযুগের পাঠাগার
প্রথম আরব গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দামেস্কে বা দামাস্কাসের উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (৬০২-৬৮০) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বই শিল্পের অধিকাংশই তখন আবর্তিত হত মসজিদকে ঘিরে। অধিকাংশ ছোট গ্রন্থাগার ছিল মসজিদের অংশ, যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল গ্রীক, পাহলভি, সিরিয়াক এবং সংস্কৃত ভাষার বইগুলিকে আরবি-তে অনুবাদ করা। চতুর্দশ শতাব্দীর বিখ্যাত ভ্রমণকারী ইবনে বতুতার (১৩৬৮) বিবরণ অনুসারে, দামাস্কাসে বই বিক্রির বাজারটি উমাইয়া মসজিদের খুব কাছে অবস্থিত ছিল। বই ছাড়াও, সেখানকার ব্যবসায়ীরা খাগের কলম, কালি, চামড়া, শক্ত কাগজ, আঠা থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম কাগজ- অর্থাৎ সাহিত্য ব্যবসার সমস্ত সরঞ্জাম বিক্রি করতেন। ঐতিহ্যগতভাবে মুসলমানরা তাদের বইয়ের সংগ্রহ মসজিদে দান করতেন।
মুসলিম বিশ্বে তিনটি বিখ্যাত গ্রন্থাগার ছিল: বাগদাদের আব্বাসীয় গ্রন্থাগার ‘হাউস অফ উইসডম’, কায়রোতে ফাতেমিদ খলিফাদের গ্রন্থাগার এবং কর্ডোবার স্প্যানিশ উমাইয়া খলিফার গ্রন্থাগার।
নবম শতাব্দীর পর থেকে, বহু পাঠাগার বিজ্ঞানের বই রাখতে শুরু করে। এর মধ্যে কয়েকটি গ্রন্থাগার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল, আবার কয়েকটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খলিফা, আমীর (গভর্নর), সুলতান এবং উজিররা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আব্বাসিদ মোসুলে খিজানাত আল-কুতুব নামের একটি বিশাল গ্রন্থাগার ছিল। একইভাবে ধনী বস্ত্র ব্যবসায়ী আলী বি. মুহাম্মদ আল-বাজাজ (৯৪২)-এর নিজস্ব গ্রন্থাগার বা বায়ত আল-ইল্ম (বিজ্ঞান বা জ্ঞানের ঘর)-এর কথা সেই আমলে বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
দশম শতাব্দীতে, গ্রন্থাগার ও বিদ্যালয় নির্মাণ ক্ষেত্রে জোয়ার এসেছিল। যার ফলে বসরা, ইসফাহান, নিশাপুর, রায়, দামাস্কাস এবং কায়রোতে বহু সংখ্যক গ্রন্থাগার ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয়, তৎকালীন সময়ে ভারতের মতো দেশ যেখানে মুসলিম শাসন কায়েম ছিল, সেখানেও একাধিক গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল। আজও সেই সমস্ত গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব রয়েছে এবং বহু মূল্যবান গ্রন্থ এখনও সেখানে রয়েছে। দিল্লির সুলতান আমল এবং মুঘল শাসনামলে নির্মীত গ্রন্থাগারের কথা অনেকেই জানা। তবে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের রামপুর যখন মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল, তখন সেখানকার নবাব সাইয়েদ মুহাম্মদ সাইদ খানের দ্বারা নির্মীত রাজকীয় গ্রন্থাগারে বইয়ের সংগ্রহ আজও শিক্ষাবিদদের অবাক করে। এই গ্রন্থাগারটি হল এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর গ্রন্থাগার।
কুতুব খানা রিয়াসাত-এ-রামপুর
মুঘল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হলে রোহিলাখন্ডে কয়েকটি স্বাধীন রিয়াসত প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনই একটি রিয়াসত রামপুরের রিয়াসত। নবাব ফয়জুল্লাহ খানের সময়ে এখানে একটি কুতুবখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় বইপত্রের অনুবাদ ও অনুলিপি প্রস্তুতের কাজ। নবাব সাইয়েদ মুহাম্মদ সাইদ খানের শাসনামলে (১৮৪০-৫৫) গৌরবপ্রাপ্ত এই রাজকীয় গ্রন্থাগারের নাম ছিল কুতুব খানা রিয়াসত-ই-রামপুর। ওই সময় এই কুতুবখানার জন্য এক হাজার চারশো স্বর্ণমুদ্রার বই ক্রয় করা হয়। এই সময় হুমায়ুন নামা, আকবরনামা, খাজানাতুল আলম, তারীখে নাদেরী, খুলাসাতুত তাওয়ারিখ, তারীখে জাহান খফী, তারীখে মজমায়ে মাহফিল, ইত্যাদী ইতিহাস গ্রন্থ ঐ কুতুবখানায় ছিল।
নবাব সাইয়েদ মুহাম্মদ ইউসুফের সময় এই কুতুবখানার জন্য দুই হাজার সাতশো রুপী সমমূল্যের বই ক্রয় করা হয়। নবাব কলব আলী খানের সময় ৪৩ হাজার ছয়শো আট রুপীর বই কেনা হয়। তাফসীর, হাদিস, আসমাউর রিজাল, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, ইলমুল কালাম, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, রসায়ন, চিকিতসাবিদ্যা, সাহিত্য, অলংকারশাস্ত্র, অভিধান, নাহু, সুরফ এসব বিষয়ে প্রচুর বই ছিল এই কুতুবখানায়। এই বংশেরই নবাব হামিদ আলী খানের আমলে এই গ্রন্থাগারের কর্মীরা (১৯২৮ সালে) আরবি ও ফারসি বই এবং পাণ্ডুলিপির একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন। আমীর মিনাই, হাকিম আজমল খান, ইমতিয়াজ আলী খান আরশির মতো বিখ্যাত শিক্ষাবিদরা এখানে প্রধান গ্রন্থাগারবিদের পদ সামলেছিলেন।
এই গ্রন্থাগারের সংগ্রহে ১৮৭৯ সালে ৯৩৪৭টি বই ছিল, সেই সংখ্যা ১৯২৭ সালে বেড়ে হয় ২৪,১১৭। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী এই কুতুবখানায় ২৪১১৫ টি বই ছিল। বর্তমানে এখানে বইয়ের সংখ্যা ৫৫,০০০ যার মধ্যে ১৫,০০০ বিরল পাণ্ডুলিপি রয়েছে। এই গ্রন্থাগারের সংগ্রহশালায় থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহটি হল পবিত্র কুরআনের প্রথম অনুবাদের আসল পাণ্ডুলিপি। এছাড়াও, সংস্কৃত, ঊর্দু, পুশতু, তামিল ভাষারও বহু বইয়ের সম্ভার রয়েছে এই গ্রন্থাগারে।
বর্তমানে ভারত সরকারের আওতাধীন
ভারতের স্বাধীনতার পরে একটি ট্রাস্ট গঠন করে তাদের হাতে এই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব দেওয়া হয় । ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সেই ট্রাস্টই এই গ্রন্থাগার পরিচালনা করত। সত্তরের দশকে ভারত সরকারের শিক্ষা, সমাজ কল্যাণ ও সংস্কৃতি বিভাগের মন্ত্রী প্রফেসর এস. নুরুল হাসান একাধিক বার এই গ্রন্থাগার পরিদর্শন করেন। সেই সময় এই গ্রন্থাগারের বেহাল দশা তাঁর নজর এড়ায়নি। ট্রাস্টের কাজে অখুশি নুরুল হাসানের উদ্যোগেই ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই ভারত সরকার এই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব নিজের হাতে নেয়। বর্তমানে ভারত সরকারের সংস্কৃতি বিভাগের অধীনে জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম হল এই গ্রন্থাগার, বর্তমানে এর নাম- রামপুর রাজা লাইব্রেরি। এর রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে সমস্ত খরচ দেয় ভারতের সরকার।