কফি- অতীতের মুসলিম রাখালের ‘এনার্জি ড্রিংক’

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কফি একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নাস্তার টেবিলে পানীয় হিসেবে কফির জুড়ি নেই। কফিতে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে। যা আমাদের দেহের কোষগুলোকে ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ ও রাসায়নিকের মিশ্রণ ঠেকাতে সাহায্য করে। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন প্রায় ১,৬০০,০০০,০০০ কাপ কফি পান করা হয়। বিলিয়ন এরও বেশী মানুষ দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হিসেবে এর উপর নির্ভর করে। ইথিওপিয়াকে কফির জন্মস্থান মনে করা হয়। ইথিওপিয়ায় জন্ম নেওয়া কফি গাছ থেকে পাওয়া কফিকে বলা হয় ‘অ্যারাবিকা’। কিন্তু এখনো খুব কম মানুষই জানে এই বিস্ময়কর আবিষ্কারটি ছিল একজন মুসলিমের।
কফির আবিষ্কার-
ইতিহাস থেকে জানা যায়, আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ ইথিওপিয়ার কাফা অঞ্চলের খালিদ নামের এক আরব বাসিন্দা ছাগল চরানোর সময় খেয়াল করেন যে, জামের মতো এক ধরনের ফল খাওয়ার পর প্রাণীগুলোকে অনেক সতেজ দেখাচ্ছে। খালিদ ওই ফলগুলোকে সেদ্ধ করে সর্বপ্রথম কফি তৈরি করেন। ১৪ শতকের দিকে দক্ষিণ আরব উপদ্বীপ ইয়েমেনের তথা মুসলমানদের কাছে এটি একটি জনপ্রিয় পানীয় হয়ে ওঠে।
মজার বিষয় হচ্ছে রাখাল ছেলেটি এথিওপিয়ার না ইয়েমেনের এই নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বলা হয় প্রাণীদের সতেজতা দেখে বীজগুলি নিজের উপর প্রয়োগ করার সাহস করেছিল রাখাল ছেলেটি, এবং সে মনে করেছিল যে এগুলো ব্যবহার করে তার শক্তি বৃদ্ধি পাবে। সময়ের সাথে সাথে, এই বীজগুলো ভেজে খাওয়ার অভ্যাস আস্তে আস্তে পানিতে মিশিয়ে একধরনের পানীয় প্রস্তুত করে পান করতে করতেই আজকের বিখ্যাত কফিতে রুপান্তরিত হয়েছে।
মেষপালকের গল্পটি সত্য যদি নাও হয় তবুও ১৫ শতকে ইয়েমেনের উচ্চভূমি সহ উসমানী সাম্রাজ্যের অপরাপর জায়গাগুলোতেও ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। মুসলিম বিশ্বের বড় বড় শহর যেমন কায়রো, ইস্তাম্বুল, দামেস্ক, বাগদাদ সহ অপরাপর শহরগুলোতে এটি একটি জনপ্রিয় পানীয় হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। আর এ মুসলিম বিশ্ব থেকেই উচ্চ মানসম্মত কফি ইতালির ভেনিস হয়ে ইউরোপে রপ্তানি করা হত। বলা হয় ইয়েমেনে সুফী-সাধকরা বিশেষ উপলক্ষে রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য কফি পান করতেন।
কফির ইতিহাস-
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে কফি পৌঁছে যায় মক্কা ও তুরস্কে। যেখান থেকে ১৬৪৫ সালে এটি যায় ইতালির ভেনিস নগরীতে। ১৬৫০ সালে পাস্ক রোসী নামের এক তুর্কীর হাত ধরে এটি ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে। তিনি লন্ডন নগরীর লোম্বার্ড স্ট্রিটে সর্বপ্রথম কফির দোকান দেন। যদিও ক্যাথলিক চার্চ কতৃপক্ষ কফিকে প্রথম দিকে মুসলিম পানীয় হিসেবে নিন্দা করত কিন্তু খুব দ্রুতই কফি ইউরোপিয়ান সমাজের অংশে রূপান্তরিত হয়েছিল। ১৬ শতকের কফি হাউসগুলো অধিকাংশ সময়েই দার্শনিকদের আড্ডার স্থানে পরিণত হয়েছিল যেখানে বসেই তারা মানবাধিকার, সরকারের রূপরেখা ও গণতন্ত্রের মত দর্শনগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। কফি খেতে খেতে আলোচিত হওয়া এই বিষয়গুলোই পরবর্তীতে আধুনিক বিশ্বের জন্য এক বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। সেই ইয়েমেন/ইথিওপিয়ান রাখালের হাত ধরে পথ চলে ইউরোপের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারা কফি আজ প্রতিদিন এক বিলিয়ন কাপেরও বেশী খাওয়া হচ্ছে। তাই বলাই যায় মানব ইতিহাসে মুসলিমদের এ ছিল এক অনবদ্য আবিষ্কার।