কান্না আসলে আপনার সন্তানের জন্য উপকারী, কীভাবে?

মানুষ স্বভাবত আবেগপ্রবণ। সে তার অনুভূতির প্রকাশ করে কান্না, হাসি, ক্ষোভের মাধ্যমে। এক এক জনের অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ এক এক রকম হয়। বলাবাহুল্য আমরা যদি আমাদের ভিতরের জমে থাকা অনুভূতির যথার্থ বহিঃপ্রকাশ না ঘটাতে পারি, তাহলে আমাদেরই মন বিচলিত থাকবে, অন্য কোনও কাজ করার সময়েও মনোসংযোগ বজায় রাখা আমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না। একই বিষয় হতে পারে আপনার শিশুর প্রতি।
কান্না কেন ঘটে?
তবে শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম। তাদের কান্নার পেছনে সব সময়ই কোনও না কোনও কারণ থাকে। তারা যেহেতু কথা বলতে জানে না, তাই কান্না মধ্যে দিয়েই বোঝায় তাদের যাবতীয় সমস্যার কথা। আর আপনার শিশুটি ঠিক কী কারণে কাঁদছে সেটা বোঝা এবং জানাটা বিশেষ প্রয়োজন। বেশি গরম কিংবা ঠাণ্ডা লাগলে, ভয় পেলে, একা বোধ করলে, ব্যথা পেলে, ক্ষুধা লাগলে অথবা মন খারাপ হলেও কাঁদতে পারে শিশু। সময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন আপনার শিশু কী চাচ্ছে। তার আচরণ মন দিয়ে দেখুন, তার ইশারা বোঝার চেষ্টা করুন। ধীরে ধীরে আপনি ঠিকই বুঝবেন তার ভাষা।
সুতরাং, আপনার শিশুটির কান্না থামানোর জন্য আপনি কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করতেই পারেন, কিন্তু তা করার আগে কয়েকটি বিষয় আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন। আবেগ, বিশেষত দুঃখ, রাগ এবং উদ্বেগের মতো বিষয়গুলো শিশুর মনের মধ্যে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যদি আমরা তাদের বের না করি তাহলে তা আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের উপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে, আমরা যদি বাচ্চার মনের ব্যক্তিগত আবেগকে বজায় রাখার চেষ্টা করি, তাঁকে কান্না-কাটি করে মন হালকা করার সুযোগ দিই তাহলে সম্ভবত বিষয়গুলো তাঁদের মনের মধ্যে এতটাও প্রভাব ফেলতে পারবে না। অনেকাংশেই কান্না-কাটি করার পরে তারা হালকা বোধ করতে পারে। কিছুসময় পরে তারা হয়তো আবার মানসিকভাবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারবে। তাতে মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব, নয়তো দুঃখ-কষ্ট এবং ক্ষোভ ক্রমাগত মনের মধ্যে জমতে থাকলে তার বহিঃপ্রকাশের মাত্রাটি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
কান্না কেন প্রয়োজনীয়?
এই প্রসঙ্গসূত্রেই আপনি আপনার শেষ কবে কেঁদেছিলেন সে কথা আবার ভাবুন। যখন জিনিসগুলি খুব বেশি হয়ে যায় এবং আপনি এটিকে আর ধরে রাখতে পারবেন না এবং আপনি হৃদয়কে আর সংযত রাখতে পারেন না, ঠিক তখনই আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। সুতরাং কান্নাকাটিরও যে একটি ভাল দিক আছে সে কথা আমরা বলতেই পারি।
আমাদের চোখের জল বা অশ্রুর বিজ্ঞানসম্মত যৌক্তিকতা অবশ্যই রয়েছে। সাধারণভাবে অশ্রু তিনপ্রকার-সুখের অশ্রু, দুঃখের অশ্রু, কৃত্রিম অশ্রু যেমন পেঁয়াজ কাটার সময় অশ্রু যে অশ্রু নির্গত হয়! নানা গবেষণায় দেখা গিয়েছে দুঃখ এবং মন খারাপের অশ্রুতে এবং কেবল এই দুইধরণের অশ্রুতে কর্টিসল নামে একটি হরমোন উপস্থিত রয়েছে। কর্টিসল হ’ল স্ট্রেস হরমোন এবং তাই আমাদের বাচ্চারা যখন কাঁদে তখন তারা কার্যকরভাবে তাদের দেহ থেকে চাপ অনেকাংশেই মুক্ত হয়ে যায়! আমরা যখন তাদের কাঁদতে বাধা দেই, তবে উপরের যে কোনও কৌশল দ্বারা বিধি নিষেধ চাপিয়ে দিই তখন আমরা কার্যকরভাবে তাদের দেহের মধ্যে স্ট্রেস ধারণ করতে বাধ্য করি। যা অনিবার্যভাবে ক্ষতিকারক প্রভাবের দিকে ঠেলতে থাকে।
কান্নার আবেগ ও অনুভূতিঃ
আসলে এই আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ করার ক্ষেত্রে হয়েছে মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের বিশেষ কয়েকটি সূত্র। তবে সহজভাবে বলতে গেলে মানব মস্তিষ্কের দুটি অংশ -উর্ধ্ব মস্তিষ্ক (যা চিন্তাভাবনা, যুক্তি এবং স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিশক্তি নিয়ে নির্মিত) এবং নিম্ন মস্তিষ্ক (যা আবেগকে ধারণ করে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি নিয়ে নির্মিত)। উর্ধ্ব মস্তিষ্কের দ্বারা আমাদের শিশুদের ভাবনা-চিন্তা পরিচালিত হোক এমনটা আমরা চাই কিন্তু আবেগের বশবর্তী হওয়ার কারণে শিশুদের চিন্তাধারা পরিচালিত হয় নিম্ন মস্তিষ্কের দ্বারা, তখন স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের স্বাভাবিক বিচার বিবেচনাবোধ বাধাপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং, উর্ধ্ব মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা পুনরায় একই স্থানে আনতে চাইলে শিশুর আবেগকে নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে তাকে কাঁদতে দেওয়া উচিত।
কেন আমরা এটি পরিচালনা করতে পারি না তার অন্য একটি বড় কারণ রয়েছে। কারণ আমরা সবসময়ই তাদেরকে খুশি রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের একটা কথাও মনে রাখতে হবে যে আবেগ অনুভূতি মানুষের মনের স্বাভাবিক বিষয়। সুতরাং কান্নাকাটি করা এবং শোক করা ঠিক নয় এই ধারণা ভুল; এটি প্রাকৃতিক এবং আসলে খুব স্বাস্থ্যকর! সুতরাং যখন আমাদের বাচ্চারা এটি করে, তখন এটি বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। কান্নার মাধ্যমে দুঃখগুলো বেরিয়ে যাওয়াটাই শ্রেয়।