কীভাবে ইসলাম ধর্ম ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল?

মধ্য প্রাচ্যে ইসলাম প্রসারের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল সংঘাত, কিন্তু চীন বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রসার ঘটেছিল শান্তিপূর্ণ ভাবে। বিশ্বের এই অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করেছিল বাণিজ্যের পথ অনুসরণ করে। বলা হয় যে, প্রথম যে মুসলিম চীন সফর করেছিলেন তিনি হলেন সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)। মনে করা হয়, তিনি ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে ক্যান্টন (কুয়াংচৌ) শহরে এসেছিলেন। ৬৫১ সালে একটি দূতাবাস স্থাপনের জন্য সাদ তৃতীয় বার চীন সফরে এসেছিলেন। তাং সম্রাট গাওজং তাতে সম্মতি প্রদান করেন এবং ক্যান্টনে একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। এভাবেই ক্যান্টন (কুয়াংচৌ)-তে চীনের প্রথম মুসলিম জনবসতি গড়ে উঠেছিল।
মোঙ্গল সাম্রাজ্যের বিস্তার
প্রথম যে আরব ব্যবসায়ীরা চীনে পৌঁছেছিলেন, তাঁরা এসেছিলেন সাদার্ন সিল্ক রোড ধরে। যদিও চীনে ইসলামের আগমনের সময় নিয়ে পশ্চিমী শিক্ষাবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
আরও উত্তরে গেলে পড়বে মধ্য এশীয় সিল্ক রোড, যা মধ্য প্রাচ্য থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে সমরখন্দ, কাশগার এবং চীনে পৌঁছেছে। চীন পরিদর্শন করা বহু মুসলমান যুবক স্থানীয় মহিলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেখানেই বসতি স্থাপন করেছিলেন। ফলে মুসলিমদের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এবং এর কয়েকশো বছর পরে ইউয়ান রাজবংশের (১২৭১–১৩৬৮) শাসন কালে বহু মুসলিম বিশাল মোঙ্গল সাম্রাজ্যের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন।
বর্তমানে, মুসলমানরা চীনের মোট জনসংখ্যার দুই শতাংশেরও কম, তবে সংখ্যার দিক থেকে দেখলে চীনে এখনও প্রায় দুই কোটির বেশি মুসলমান রয়েছেন। চীনের 55 টির মধ্যে সরকারীভাবে স্বীকৃত জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে মুসলিমরা রয়েছেন। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, চীনে মসজিদের সংখ্যা ৩৫ হাজার এবং ৪৫ হাজার ইমাম রয়েছেন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হল সমগ্র এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশ, ভৌগোলিকভাবে বলা যেতে পারে- চীনের দক্ষিণে, ভারতের পূর্বে, নিউ গিনির পশ্চিমে এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে অবস্থিত দেশগুলির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া । ২৪০ মিলিয়নেরও বেশি অনুগামী-সহ ইসলামই এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম।
কীভাবে ইসলাম ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল?
আল্লাহের বার্তা বহনকারী আরব ব্যবসায়ীদের সাথে এই অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল বর্ষার উতল হাওয়ার মতো দুরন্ত গতিবেগে। ইন্দোনেশিয়াতে বর্তমানে মুসলিমদের সংখ্যা হল মোট জনসংখ্যার ৮৮% এবং মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে তা ৬১.৩%।
এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ার ১৭ থেকে ১৮ হাজার দ্বীপ রয়েছে । এটি হল বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যাবিশিষ্ট দেশ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি। ইন্দোনেশিয়ার কৌশলগত অবস্থান আন্তঃদ্বীপ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছিল, যা এই দেশের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
আব্বাসীয় খিলাফতের প্রাথমিক বিবরণ অনুসারে, ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জটি জায়ফল, লবঙ্গ এবং আদাজাতীয় এক ধরনের মশলা গলঙ্গলের প্রাচুর্যের কারণে মুসলিম নাবিকদের কাছে বিখ্যাত ছিল। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে বহু আরব ব্যবসায়ীরা সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মালিক আল-সালেহের কবরের উপরে নির্মীত স্মৃতিসৌধটি হল ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া প্রাচীনতম ইসলামী শিলালিপিগুলির মধ্যে একটি। এর থেকে জানা যায় যে, সুমাত্রার একটি রাজ্য সমুদ্রের প্রথম শাসক মুসলমান ছিলেন।
পরিব্রাজকদের লেখনীতে
শুধু তা-ই নয়, বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো ১২৯২ সালে চীন থেকে ইউরোপ ফেরার পথে উত্তর সুমাত্রায় থেমেছিলেন। তখন তিনি পার্লাক নামের একটি ইসলামিক শহর পরিদর্শন করেছিলেন। আবার আরব পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৪৫-৪৬ খ্রিস্টাদে পার্লাক শহর পরিদর্শন করেছিলেন এবং লিখেছিলেন যে, এর রাজা একজন সুন্নি মুসলমান। ইসলাম ধীরে ধীরে সমগ্র ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় লোকেরা ইসলামের সংস্পর্শে আসেন এবং ধর্মান্তরিত হন। ভারত, চীন এবং মধ্য প্রাচ্যের বিদেশী মুসলমানরা ইন্দোনেশিয়া সফরে এসে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। মনে করা হয় যে, বিদেশ থেকে এসে বসতি স্থাপন করা নতুন নাগরিকরা নিজেদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপরে জোর করে চাপিয়ে দেয়নি। পরিবর্তে তাদের স্থানীয় সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিল।
মালয় দ্বীপপুঞ্জে ইসলামের বিস্তার শান্তিপূর্ণ ভাবে
পুরো মালয় দ্বীপপুঞ্জ এক সময় মালয়েশিয়া নামে পরিচিত ছিল; তবে পরবর্তীকালে, এর সীমানা ভৌগোলিকভাবে খর্বিত হয়। এবং উনিশ শতকের শেষের দিকে ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রিটেন উপনিবেশের অধীনস্থ অংশই মালয়েশিয়া নামে পরিচিত হয়। ১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়ার পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের কিছু অংশ এই দেশে মিশে যায়। পশ্চিম মালয়েশিয়া থাই সীমান্ত থেকে সিঙ্গাপুর দ্বীপ পর্যন্ত প্রসারিত এবং এটি মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত। বোর্নিও-র উত্তর প্রান্তে অবস্থিত সাবাহ এবং সারাওয়াক অঞ্চল নিয়ে গঠিত যা পূর্ব মালয়েশিয়া।
টিন, কর্পূর, ব্রাজিলউড, আবলুস এবং সোনার মতো প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল মালয়েশিয়া।
তাই যুগে যুগে জাহাজগুলি এই উপদ্বীপের উপকূলকে ডক হিসেবে ব্যবহার করে ব্যবসা চালিয়েছে। মালাক্কা উপদ্বীপের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের জেরে চীন, ভারত এবং মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল এবং এভাবে কোনও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়াই ইসলাম এই অঞ্চলটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। মালাক্কা নামটি এসেছে আরবি শব্দ মালাকুট থেকে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে এখানে একটি আরব ট্রেডিং পোস্ট নির্মীত হয়েছিল এবং ইসলাম ইন্দোনেশিয়ায় যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, ঠিক তেমন ভাবেই মালয় উপদ্বীপেও ছড়িয়ে পড়েছিল। হয় স্থানীয় বাসিন্দারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, বা ব্যবসায়ীরা এই স্থানে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিল।
ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, যখন এই এলাকায় স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজদের আগমন ঘটে, তত দিনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম দৃ ঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিকতাবাদ সত্ত্বেও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।