কীভাবে মিশর হয়ে উঠল ইসলামের দেশ? পর্ব ২

আমির ইবন আল-আস (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মিশর ধীরে ধীরে ইসলামী সমৃদ্ধির সম্মুখীন হয়। মিশরীয়দের নিজেদের বিশ্বাস ও গ্রেকো-রোমান সভ্যতার ক্যাথলিক ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে সুন্নি ইসলামের ভাবধারা আস্তে আস্তে মিলতে থাকে। অবধারিত ভাবে সুফি ভাবধারার প্রচলনও শুরু হয়। ইসলাম শান্তিপূর্ণভাবে মিশে যেতে থাকে মিশরীয়দের মননে।
ইবন আল-আসের পরবর্তী ছয় শতক মিশর আরবের খলিফাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। দশম শতকে ফাতিমিদ বংশের শাসনের সময়কাল থেকে কায়রো আস্তে আস্তে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হতে শুরু করে। অতঃপর, ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে তূর্কী-ককেশীয় জনজাতি মামলুকরা মিশর অধিকার করে নেয়।
মামলুক সুলতানি বংশের শাসনকাল
নবম শতাব্দী থেকেই ইসলামী সৈন্যদলে মামলুকদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। মামলুকরা মূলত মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন জনজাতির থেকে আসা মানুষ। প্রাথমিকভাবে এদের গৃহকর্ম, কুরআন ও ইসলামী ইতিহাস ও যুদ্ধবিদ্যা শেখানো হত। তারপর যে যেটায় পারদর্শী সেই অনুসারে কাজ ভাগ করে দেওয়া হত। কোনও কোনও ঐতিহাসিক মামলুকদের দাস বংশ বলেও ব্যাখ্যা করেছেন।
১১৬৯ খ্রিস্টাব্দে তূর্কী সেনাপতি সালাদিন নিজের ইসলামী বংশের পত্তন করেন। তাঁর আমলে মামলুকদের সৈন্য হিসাবে ব্যবহার করার প্রবণতা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পায়। কথিত আছে, তাঁর পরবর্তী সম্রাট আল মালিক আল সালিহ আইয়ুব মামলুক ক্রীতদাসদের উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর মামলুকরা মসনদ দখল করে। তারপর থেকে প্রায় ২৫০ বছর মিশর মামলুকদের অধিকারে ছিল।
ঐতিহাসিকরা মামলুকদের শাসনকালকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, প্রথমটি ১২৫০ থেকে ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দ, একে বলা হয় বাহরই শাসনকাল। দ্বিতীয়টি ১৩৮২ থেকে ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ, একে বলা হয় বুরজি শাসনকাল। বাহরই শাসনকালে মানুষের জীবনে তূর্কী প্রভাব বেশি দেখা গিয়েছিল, যেখানে বুরজি শাসনকালে প্রকট ছিল ককেশীয় প্রভাব।
মামলুকরা বিখ্যাত ছিল তাঁদের হাতের কাজ, স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক সংরক্ষণের জন্য। এই সময় ঐতিহাসিকরা অত্যন্ত নিপুণভাবে ইতিহাসের সমস্ত খুঁটিনাটি লিখে রাখতেন। যদিও তা সংরক্ষণের একদম প্রাথমিক ধাপ, তাও পরবর্তীকালে অনেককিছুই সেখান থেকে জানা গিয়েছে। এছাড়া নানা মসজিদ, প্রাসাদ ও নানাবিধ সমাধি তৈরিতে মামলুক স্থপতিরা ছিল সিদ্ধহস্ত। কায়রো শহরে এখনও মামলুক স্থাপত্যের নানা নিদর্শন দেখা যায়। এই সময় সমাজের বুক থেকে কুসংস্কার মুছে ফেলার প্রয়াসে একনিষ্ঠ ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত ইবন তাইমিয়াহ।
মিশর মামলুকদের দখলে ছিল ততদিনই যতদিন না অটোমান তূর্কীরা এসে তা অধিকার করে নেয়। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে, অটোমান তূর্কীদের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মামলুক সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়।
অটোমান তূর্কীদের মিশর
১৫১৭ সালে মিশর দখল করার পর তূর্কী সুলতান প্রথম সেলিম মিশরের দায়িত্ব তুলে দেন সেনাপতি ইউনুস পাশার হাতে। কিন্তু অনৈতিকতার দায়ে পাশা অভিযুক্ত হলে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় হায়ির বেই-এর হাতে। অদ্ভুতভাবে, এই হায়ির বেই কিন্তু মামলুক বংশজাত। ঐতিহাসিকরা বলেন, মিশরে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রাথমিক কয়েক শতক মামলুক ও তূর্কীদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের ইতিহাসে পরিপূর্ণ।
মিশরের বেশিরভাগ জমির অধিকার মামলুকদের ছিল, এবং সামন্ততান্ত্রিক প্রথা খুব নিখুঁতভাবে তারা প্রয়োগ করতে পারত। তূর্কীরা ক্রমশ শাসন ব্যবস্থা ও জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে মামলুকদের উপর নির্ভর করতে শুরু করে। এইভাবেই মামলুকরা শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপুর্ণ পদে অধিষ্ঠান করতে শুরু করে।
ঐতিহাসিকদের মতে, অটোমানদের সময় ব্ল্যাক প্লেগ ও অন্যান্য মড়কের জন্য মিশরীয় শাসনব্যবস্থা বেশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ১৬৮৭ থেকে ১৭৩১ সালের মধ্যে দেশে ছয়টি দূর্ভিক্ষ দেখা যায়। ১৭৮৪-এর অপর এক দূর্ভিক্ষে মিশরে জনসংখ্যার প্রায় বেশিরভাগের প্রাণনাশ হয়।
১৭৯৮ সালে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট মিশর দখল করেন। কিন্তু ১৮০১ সালে অটোমান তূর্কী ও মামলুকরা পুনরায় মিশর উদ্ধার করে নেয়। এই যুদ্ধে আলবেনিয়ান রেজিমেন্টের নেতা মহম্মদ আলি পাশা প্রভূত বীরত্ব দেখালে ১৮০৫ সালে ইস্তানবুলের সুলতানের ক্ষমতায় মিশরের ভাইসরয় নিযুক্ত হন। তারপর তিনি নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মিশরে কায়েম ছিল।
(চলবে)