কীভাবে মিশর হয়ে উঠল ইসলামের দেশ? শেষ পর্ব

নীলনদের যুদ্ধে নেপোলিয়ান হার স্বীকার করার পর আলবেনিয়ার রেজিমেন্টের নেতা মহম্মদ আলি পাশা মিশরের ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেন। তাঁর সম্পূর্ণ নাম ছিল মহম্মদ আলি কাভাল আলি মেহমেদ আলি পাশা।
মহম্মদ আলির রাজত্বকাল
ইস্তানবুলের সুলতানের হাত থেকে মিশরের ভাইসরয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরই তিনি এ দেশের উন্নতিতে মনোনিবেশ করেন। যদিও, ভাইসরয় সুলতানের অধীনের একটি পদ, তাও যেহেতু সেই সময় অটোমান সাম্রাজ্য আস্তে আস্তে ধ্বংসের মুখে পড়ছে তাই মহম্মদ পাশাই হয়ে ওঠেন মিশরের সর্বেসর্বা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুচতুর সেনাপতি ও শাসক। অটোমান শাসন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি নিজের বংশের শাসন শুরু করেন।
মহম্মদ পাশার মূল লক্ষ্য ছিল সামরিক। তিনি মিশরের সাম্রাজ্যের মধ্যে উত্তর সুদান, সিরিয়া এবং আরব ও আনাতোলিয়ার অংশবিশেষ অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর তাঁর সংস্কারের মধ্যে পড়েছিল মিশরকে আধুনিক সামরিক ও রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
তিনি মিশরের যুবকদের উচ্চশিক্ষার জন্য পাশ্চাত্যে পাঠানোর পক্ষপাতী ছিলেন, এমনকি কেউ বিদেশে গিয়ে পড়াশুনো করতে চাইলে স্টেট তার খানিক ব্যয়ভার বহন করত। তিনি মিশরে অন্যান্য দেশ থেকে পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানাতেন ও নানা সেমিনার ও ওয়র্কশপের আয়োজন করতেন।
এছাড়া মিশর তাঁর আমলে সবচেয়ে বেশি শিল্পায়নের সম্মুখীন হয়। তিনি অজস্র কারখানা তৈরি করেছিলেন, ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থারও বেশ উন্নতি ঘটেছিল।
পরিবহন ও সেচ ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল তাঁর আমলে। নীলনদে বাঁধ ও সেচের খাল কাটার আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করেন তিনি। কথিত আছে, দিনের মধ্যে আধঘণ্টা প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে কাটাতেন নীলনদের উন্নতিকল্পে। দেশের শাসন ব্যবস্থা ও আমলা তন্ত্রের দূর্নীতিরও অবসান ঘটান তিনি।
লম্বা তন্তু তূলার চাষে উন্নতি
মহম্মদ পাশার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হল মিশরের লম্বা তন্তু তুলো চাষের উন্নতিসাধন করা। তিনি এই চাষকে মূলত অর্থকরী ফসলে পরিণত করেন। মিশরের এই তুলো রপ্তানি হতে শুরু করে দেশে বিদেশে। শুধু তাই নয়, এই তুলো থেকে উৎপন্ন কাপড়ও ভালো দামে বিক্রি হতে শুরু করে। এরফলে মিশরের অর্থনৈতিক অবস্থা ফুলে ফেঁপে ওঠে। অনেক বিদেশি বিনিয়োগ শুরু হয়।
মহম্মদ পাশার ক্রমাগত সামরিক উন্নতিতে ভীত হয়ে ১৮৪১ সালে ইউরোপের বাকি দেশ কূটনৈতিকভাবে তাঁকে বাধ্য করে বেশিরভাগ দখলীকৃত দেশ অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করতে। তিনি তাতে সম্মত হলেও সুদান ও মিশর নিজের করায়ত্তই রাখেন। যদিও, ১৮৮২ সালে তাঁর সাম্রাজ্য ব্রিটিশদের ক্ষমতায় পরিচালিত হতে থাকে।
ব্রিটিশ অধিগ্রহণ
মহম্মদ আলির মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র প্রথম আব্বাস মসনদে বসেন। তারপর সৈয়দ ও ইসমাইল। প্রথম আব্বাস যথেষ্ট সাবধানী শাসক ছিলেন, কিন্তু তার পরবর্তী শাসকরা ছিল অমিতব্যয়ী। ফরাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুয়েজ খান খননের সময় মিশরের রাজকোষ থেকে জলের মত টাকা ব্যয় হয়। ইউরোপিয়ান ব্যাংকেও দেনা হয় প্রচুর। বাধ্য হয়ে ১৮৭৫ সালে ইসমাইল সুয়েজ খালের ৪৪ শতাংশ ব্রিটিশদের বিক্রি করে দেয়। এভাবেই মিশরে পা রাখে ব্রিটিশ শাসন।
১৮৮২ সালে মিশরের বাহিনীকে তেল এল কেবিরের যুদ্ধে হারিয়ে সম্পুর্ণ মিশর দখল করে ব্রিটিশরা। যদিও, ১৯৫২-এর স্বাধীনতা আন্দোলনে মিশর পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় তারা।
বর্তমানের স্বাধীন মিশর
১৯৫৩ সালের ১৮ জুন মিশর স্বাধীনতা লাভ করে। জেনেরাল মহম্মদ নাগুইব ছিলেন এ দেশের প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু, ১৯৫৪ সালে, মিশর স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নেতা গামাল আব্দেল নাসের তাঁকে অপসারণ করে নিজে শাসনভার হাতে নেন। এরপর থেকেই মিশর আস্তে আস্তে বিশ্বের দরবারে অন্যতম পরিচিত নাম হয়ে উঠতে থাকে।
মিশর, আফ্রিকার সাহারার কোল ঘেঁষে নীল নদের তীর ধরে বিছিয়ে থাকা এই দেশের ইতিহাসে যেন সত্যিই লুকিয়ে আছে অজস্র রহস্য। সেই রহস্যের আঁচ পাওয়া যায় তার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও।
(সমাপ্ত) (পর্ব ১)। ( পর্ব ২ )