কৃপণতা ও অতিরঞ্জনের মাঝামাঝি অবস্থায় অর্থ উপার্জন ও ব্যয় করা

অর্থ।
কেবল শব্দটি শোনামাত্র আত্ম-প্রবৃত্তি, বিলাসিতা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের চিত্র অন্তরে জেগে ওঠে।
আমরা অর্থকে সুখের জন্য প্রবেশদ্বার হিসাবে বিবেচনা করি আমাদের সমস্ত ইচ্ছা পূরণের একমাত্র মাধ্যম আমরা অর্থকে মনে করি। এটা বললে অতিরঞ্জিত হবে না যে, প্রত্যেকেই তার ইচ্ছামত অর্থব্যয় করতে পছন্দ করে বা আনন্দিত হয়।
ইসলামে অর্থকে রিজিক এবং আল্লাহর কাছ থেকে আস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মুসলমানদেরকে কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, উত্তরাধিকার প্রভৃতি অনুমতিযোগ্য উপায়ে অর্থ উপার্জন বা সম্পদ অর্জনের অনুমতি দেওয়া হয়। উপকারী নয় এমন জিনিসের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি এবং অর্থের অপচয়কেও ইসলাম নিষেধ করে। অপরদিকে গোপনে এবং প্রকাশ্যে দান-সদকা করার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
ধনী হওয়া মনের উপর নির্ভর করে
বেশিরভাগ সময়, কোনো ব্যক্তির ব্যয় এবং সংরক্ষণের অভ্যাস অর্থের প্রতি তার মানসিকতা বা বিশ্বাস এবং অর্থ সম্পর্কে তার চিন্তার ফল। এই মানসিকতা তার শৈশবকালীন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় এবং বিশেষত বড় হওয়ার সময় তার বাবা-মা যেভাবে তাকে অর্থ সম্পর্কে শিক্ষা দেয় তার ফলস্বরূপ। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে আমি লক্ষ্য করেছি যে, বেশিরভাগ মানুষই তাদের শৈশবকালের মানসিকতাকে ভিত্তি হিসেবে আঁকড়ে থাকে, যদি না তারা সক্রিয়ভাবে অর্থ সম্পর্কে চিন্তা করার উপায়টি পরিবর্তন করার চেষ্টা করে।
আমাদের মধ্যে অনেকে বিশ্বাস করে যে, বেশি অর্থ উপার্জন আমাদেরকে আরও আনন্দিত করবে। সে কারণেই, আমাদের বেশিরভাগই আরও বেশি বেশি উপার্জন করতে বিভিন্ন পন্থার সন্ধানে থাকে।
ইসলাম আমাদের প্রয়োজন মেটাতে পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জনের জন্য উত্সাহ দেয়, যাতে কারও কাছে কখনও আর্থিক সাহায্য চেতে না হয়। তবে অর্থ উপার্জনে বিভিন্ন দিকনের্দেশনাও দেয় যার বাইরে যাওয়ার অনুমতি আমদেরকে দেওয়া হয় না।
অন্তরে সম্পদের লোভ আছে কিনা তা যাচাই করুন
রাসসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আদমসন্তানের যদি দুই উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, তাহলে সে কামনা করে- তার যদি আরেকটি উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ থাকত! মাটি ছাড়া কোনো কিছুই তার মুখ পূর্ণ করতে পারবে না!” (জামে তিরমিযী)
অর্থের প্রতি লোভের একটা স্তর তো এমন- কেউ অর্থসম্পদের পেছনেই তার জীবনকে ব্যয় করে দিল। জীবনের সুখ-আরাম ভুলে গিয়ে কেবলই টাকা আর টাকা! অধিক সম্পদ উপার্জনের লোভে যে এভাবে নিজেকে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে বিলিয়ে দেয়, নিজের উপার্জিত টাকা সে আর ভোগ করে যেতে পারে না। এখানে অবশ্য ব্যক্তি কেবল তার নিজের আরামকেই হারাম করে, অন্য কেউ তার দ্বারা আক্রান্ত হয় না।
লোভের আরেকটি স্তর হচ্ছে- নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য অন্যকে আক্রান্ত করা, প্রভাব খাটিয়ে কিংবা কোনো কৌশলে অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। লোভের উপরোক্ত প্রথম স্তরটিও প্রশংসনীয় নয় মোটেও, কিন্তু দ্বিতীয় স্তরটি সম্পূর্ণই হারাম। বলে-কয়ে হোক আর গোপন চক্রান্তের মাধ্যমে হোক, সর্বক্ষেত্রেই তা নিন্দনীয়, অবৈধ। এ লোভই মানুষের পতন ডেকে আনে। তবে এটাও অনস্বীকার্য যে, জীবনে চলতে গেলে অর্থ লাগেই।
অর্থ উপার্জনে মধ্যমপন্থা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। জেনে রেখো, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার জন্যে নির্ধারিত রিজিক পূর্ণ না করে ততক্ষণ তার কিছুতেই মৃত্যু হবে না। একটু দেরিতে হলেও তা তার কাছে পৌঁছবেই। তাই আল্লাহকে ভয় করো। উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। হালাল যতটুকু তা গ্রহণ করো আর যা কিছু হারাম তা বর্জন করো।” (ইবনে মাজাহ)
এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লোভের দুটি স্তর থেকেই বেঁচে থাকার পথ নির্দেশ করেছেন। তিনি একদিকে উচ্চারণ করেছেন আশ্বাসবাণী- তোমার জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে যতটুকু রিজিক নির্ধারিত, তা তুমি পাবেই। যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণরূপে তা ভোগ না করবে ততক্ষণ তোমার মৃত্যু হবে না। এই বিশ্বাস বুকে ধারণ করে তুমি আল্লাহকে ভয় করে চলো আর সহজে যতটুকু সম্ভব উপার্জনের চেষ্টা করো। উপার্জনের পেছনে পড়ে তুমি তোমার জীবনকে নিঃশেষ করে দিয়ো না। এ জীবন অনেক মূল্যবান; একে কাজে লাগিয়েই তোমাকে অর্জন করতে হবে মৃত্যু-পরবর্তী অনন্ত জীবনের পাথেয়। দ্বিতীয়ত তিনি বলেছেন, উপার্জন করতে গিয়ে হালাল-হারাম দুটি পথেরই তুমি সন্ধান পাবে। আল্লাহকে ভয় করে সর্বপ্রকার হারাম থেকে তুমি বেঁচে থেকো। হালাল পন্থায় যতটুকু সম্ভব হয় ততটুকুই তুমি অবলম্বন করো। হয়ত একটু বিলম্ব হবে, কিন্তু তোমার নির্ধারিত রিজিক তোমার কাছে আসবেই।