চীনের শিয়ান শহরের বড় মসজিদ এবং মুসলিম কোয়ার্টার

চিনের শাংহাই এবং বেজিং শহরের মুসলিম ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল, কিন্তু চীনের শিয়ান শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্যই অজানা। সেই কারণে বহু মুসলিম চীনে গেলেও এই জায়গাগুলি সম্পর্কে না জানার ফলে অনেক কিছুই না দেখে চলে আসেন। তাই তাঁদের কথা ভেবেই দেওয়া হল শিয়ান শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে কিছু তথ্য।
চীনের প্রাচীর ও ফরবিডেন সিটি (নিষিদ্ধ নগরী) ঘুরে দেখার পরে বুলেট ট্রেন ধরে সোজা চলে আসতে পারেন শিয়ানে। ঘণ্টাখানেক যাত্রা করার পরে, স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়েই চলে যেতে পারেন টেরাকোটা যোদ্ধাদের সাথে মোলাকাত করতে। একটা দিন সেখানে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিন। পর দিন চলে যান শিয়ান মুসলিম কোয়ার্টার এবং গ্রেট মস্ক বা বড় মসজিদ দর্শন করতে।
চীনের শিয়ান শহরের মুসলিম সম্প্রদায়
এই শিয়ান শহরের পূর্ব টার্মিনাসে অবস্থিত প্রাচীন সিল্ক রোড- যা চীনের সাথে রোমান সাম্রাজ্যের সংযোগ স্থাপনের একমাত্র পথ ছিল। এই সিল্ক রোডের মাধ্যমেই শিয়ান বিভিন্ন বস্তু, সংস্কৃতি এবং ধর্মের সান্নিধ্যে এসেছিল। চীনের মধ্যে শিয়ানেই সর্বপ্রথম মুসলিম সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। আজ, এখানে অন্তত ৭০ হাজার এথনিক হুই চীনার বসবাস – এঁরা হলেন হান্স সম্প্রদায়ভুক্তদের সাথে আরব ও পার্সী বণিকদের বিবাহসূত্রে উদ্ভূত বংশধর। চীনে বসবাসকারী মোট মুসলিম জনসংখ্যা ১০ মিলিয়নের কাছাকাছি, তাঁদের অনেকেরই পূর্বসূরী ছিলেন এই বণিকরা। এবং এই প্রাচীন পথ ধরেই এই দেশে তাঁদের আগমন হয়েছিল।
কয়েক শতাব্দী-প্রাচীন সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ফল হল এখানে প্রাচীনতম ও চীনের অন্যতম বিশাল মসজিদ নির্মাণ। এই সুবিশাল জামা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল ৭৪২ সালে, ট্যাং সাম্রাজ্যের শাসনকালে। ফলে এই মসজিদ ঠিক ততটাই পুরোনো, যতটা চীনের মাটিতে ইসলামের ইতিহাস।
এই মসজিদকে ঘিরে রয়েছে সমৃদ্ধ এবং রঙিন মুসলিম কোয়ার্টার। এর ব্যস্ত রাস্তায় হাতছানি দেয় ঐতিহ্যশালী হুই খাবার, হালাল খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁ। প্রতিটি দোকানে সাজানো রঙিন কাপড় দিয়ে। তাদের ভিতরে ঢুকলেই মশলার গন্ধ পাওয়া যায় এবং এখানকার চীনা খাবারের স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। এই দোকানগুলিতে ঢুকলে নিমেষে মনে হবে, কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গিয়েছেন। যে কোনও সময় কোনও আরবী বণিক এসে আপনার পাশে এসে বসবেন।

চীনের শিয়ান শহরের জামা মসজিদের বর্ণনা
শিয়ানের বড় বা জামা মসজিদের মূল প্রবেশপথ খুব একটা স্পষ্ট নয়। খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য না করলে অনেকেই এটি পেরিয়ে চলে যাবেন। দেওয়ালের আড়ালে লুকানো এই দরজা বাইরে থেকে দেখা প্রায় অসম্ভব এবং এর দ্বারা বোঝা যায়, সবার জন্য এই প্রবেশদ্বার অবারিত নয়। আর এই উপলব্ধি যে কতটা সত্য, তা বুঝতে পারবেন এই মূল ফটক পেরিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে পা রাখার সাথে সাথেই।
এই মসজিদের মোট পাঁচটি প্রাঙ্গণের মধ্যে অন্তত ২০টি বিল্ডিং রয়েছে। যেখানে এই মসজিদটি বর্তমানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৩৯২ সালে, মিং সাম্রাজ্যের শাসনকালে। এটি নির্মাণ করা হয়েছিল বিখ্যাত চীনা মুসলমান নেভি অ্যাডমিরাল ঝেং হি-এর উৎসাহে, যিনি কলম্বাসেরও আগে আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু, ইতিহাস তাঁকে প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করেছে। যাই হোক, চতুর্দশ শতাব্দীতে স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এই মসজিদে বহু সংযোজন ও পরিবর্তন হয়েছে আবহমান সময়ের হাত ধরে।
এই মসজিদের স্থাপত্যে ইসলাম ও চীনা সংস্কৃতির অসাধারণ মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। এই মসজিদের গায়ে সমস্ত লেখনি রয়েছে সিনি ভাষাতে, যা হল চীনা হরফ দ্বারা প্রভাবিত আরবী অক্ষর, তার সাথে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী চীনা এবং আরবী ক্যালিগ্রাফির ফিউশন, যার নমুনা সর্বত্র দেখা যায়।
কাঠের গায়ে ক্যালিগ্রাফির টান
এটি ইস্তানবুলের নীল মসজিদের মতো নয়। এখানে অন্দরসজ্জার বাহুল্য নেই। এখানে ঝলমলে আলোর উপস্থিতি নেই, কিংবা ছাদ থেকে ঝুলন্ত চোখ ধাঁধানো ঝাড়বাতির আড়ম্বর নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই মসজিদের সৌন্দর্য অতুলনীয়। এর সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে নিখুঁত কাজের মধ্যে। কাঠের গায়ে খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অসাধারণ ক্যালিগ্রাফি। বিভিন্ন সময়ে এই মসজিদে একাধিক বার সংস্কারের কাজ হয়েছে, বহু পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু এই মসজিদের প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ মুছে যায়নি, তার আসল কাজগুলি অবিকৃত রয়েছে।
সিল্ক রোডের ইস্টার্ন টার্মিনাসে অবস্থিত এই স্থানে দাঁড়িয়েই উপলব্ধি করতে পারবেন, এক প্রাচীন নগরীতে, এই সম্পূর্ণ একলা প্রাচীন মসজিদটি হল বিশ্বাসের প্রতীক, যা বিভিন্ন সময়ে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের পরেও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
এই ভাবনা এবং এর সৌন্দর্য বলে কিংবা লিখে ব্যাখ্যা করা কঠিন। কিন্তু এই মসজিদে গিয়ে দাঁড়ালে প্রত্যেক মুসলিম উপলব্ধি করতে পারবেন, শিয়ানের মুসলিম কোয়ার্টার এবং তার বড় মসজিদ ঠিক কতটা অসাধারণ।