চীনে মসজিদের স্থাপত্যরীতির সাথে মিশেছে চীনা সংস্কৃতি

বিশিষ্ট সাহাবী সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর হাত ধরে চীন ভূখণ্ডে পা রেখেছিল ইসলাম ধর্ম। অবশ্য তাঁর আগমনের আগেই এই নতুন ধর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন চীনের তৎকালীন তাং সাম্রাজ্যের রাজা তাই সুং। পারস্যের সাসানিদ রাজা এবং বাইজান্টিয়ামের রাজার তরফে দূত প্রেরণ করে চীনের রাজাকে ইসলামিক শাসনের উত্থানের বিষয়ে যখন অবহিত করা হয়েছিল। পাশাপাশি এই দুটি দেশই চীনের কাছ থেকে সুরক্ষা প্রার্থনা করেছিল। তবে, সম্রাট কাও-সুং সিংহাসনে বসার পরে দ্বিতীয় বছরই একজন মুসলিম রাষ্ট্রদূত চীন দেশে প্রথম সরকারী সফরে যান।
সহজে ইসলাম প্রসার চিনদেশে
চীনা সম্রাট ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে এই নতুন ধর্মকে সাধারণ অনুমোদন দিয়েছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল কনফুসিয়াসের শিক্ষার সাথে এই ধর্মের কোনও বিরোধ নেই। তবে তাঁর মনে হয়েছিল, দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়া এবং এক মাসের রোজা রাখা তাঁর পক্ষে কঠিন। এই কারণে তিনি ধর্মান্তরিত হননি। তবে তিনি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং তাঁর প্রতিনিধিদলকে ইসলাম প্রচারের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন এবং ইসলাম ধর্মের প্রশংসাও করেছিলেন। এর ফলে, চীনা দেশে ইসলামের প্রসার হয়েছিল খুব সহজেই।
সাদ (রাঃ) পরবর্তী সময়ে কুয়াংচৌ-তে বসবাস করতে শুরু করেন এবং হুয়াইশেং মসজিদ নির্মাণ করেন যা চীনের ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। ১৩০০ বছরেরও বেশি পুরোনো এই মসজিদটি চীনের সবচেয়ে পুরোনো মসজিদ হিসেবে খ্যাত। চীন দেশের বহু ঐতিহাসিক ওঠাপড়ার স্বাক্ষী এই মসজিদ আজ নিজেই জলজ্যান্ত ইতিহাস। মেরামত ও পুনর্নির্মাণের পরে এই মসজিদটি আধুনিক কুয়াংচৌ-তে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ কেন্দ্র।
চীনের বৃহত্তম এবং প্রাচীন মসজিদ
তার সমসাময়িক শাআনশি প্রদেশে চাংগান (বর্তমান শিয়ান)-এর দা কিংজেন সি (বড় মসজিদ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে। এটি চীনের বৃহত্তম (আয়তন ১২,০০০ বর্গ মিটার) এবং অন্যতম সেরা প্রাচীন মসজিদ এবং কয়েক শতাব্দী বয়স হওয়া সত্ত্বেও একে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই মসজিদের বর্তমান যে রূপ আমরা দেখতে পাই, তা নির্মীত হয়েছিল মিং রাজবংশের আমলে।
হংকংয়ের যাদুঘরে হুয়াইশেং মসজিদের মডেলের পাশেই দেখা রয়েছে বড় মসজিদের একটি অবিকল মডেল। তার কারুকার্যময় দেওয়াল, অভিজাত প্যাভিলিয়ন এবং বিশাল উঠোন, সমস্তটাই নিদারুণ ভাবে এই মডেলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
আসল মসজিদের ঢোকার পথের সামনেই মেঝেতে একটি ড্রাগনের চিহ্ন খোদাই করা রয়েছে, নামাজ পড়ার ঘরের ঠিক বিপরীতে এই চিহ্নের মাধ্যমে ইসলাম ও চীনা সভ্যতার মিশেল খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
বিভিন্ন মসজিদের স্থাপত্যশৈলী
শেং-ইউ সি (পবিত্র বন্ধুর মসজিদ), যা কিংজিং সি (পবিত্র মসজিদ) এবং আল-সাহাবাহ মসজিদ (সাহাবীদের মসজিদ) নামেও পরিচিত। এই মসজিদ খাঁটি গ্রানাইট পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ১০০৯ খ্রিস্টাবেদ, নর্দার্ন সং রাজবংশের সময়ে আমলে। এর স্থাপত্য নকশা এবং ধাঁচ অনেকটাই সিরিয়ার দামাস্কাসের বড় মসজিদ (9০৯-১৫)-এর অনুকরণে করা হয়েছিল।
কিংজিং মসজিদটি ফুজিয়ান প্রদেশের “মদিনাত আল-জায়তুন” (ছুয়ানচৌ) বা ইংরেজিতে, “জলপাইয়ের শহর”-এ অবস্থিত, যেখানে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) -এর সাথে চীনে আসা আরও দুই সাহাবী সমাধিস্থ রয়েছেন। স্থানীয়দের কাছে চীনা ভাষা অনুসারে “সা-কে-জু” এবং “উ-কু-সু” নামে এই সমাধি দুটি পরিচিত।
চচিয়াং প্রদেশের হাংচৌ শহরে অবস্থিত ঝেং-জিয়াও সি (প্রকৃত ধর্মের মসজিদ), যা ফেং-হুয়াং সি (ফিনিক্স মসজিদ) নামেও পরিচিত, সেটি তাং রাজবংশের আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এই মসজিদে একাধিক তলাবিশিষ্ট একটি পোর্টাল রয়েছে, যাকে মিনার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং এটি হল চাঁদ পর্যবেক্ষণ করার উপযুক্ত স্থান। মসজিদটির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং বহু শতাব্দী ধরে বেশ কয়েকটি উপলক্ষ্যে এই মসজিদের পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। তবে এটি আগের তুলনায় অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে, বিশেষত ১৯২৯ সালে রাস্তা প্রশস্ত করার সময় এই মসজিদের আকার ছোট করা হয়, এবং ১৯৫৩ এই মসজিদ আংশিকভাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।
সাদের সমাধি
অন্যান্য প্রাচীন মসজিদ অবস্থিত চিয়াংসু প্রদেশের ইয়াংজিঝাউ শহরে, যা সং সাম্রাজ্যের শাসনকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত শহর (৯৬০-১২৮০ খ্রিস্টাব্দ) ছিল। জিয়ান-হে সি (অমর ক্রেনের মসজিদ) শহরের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম মসজিদ। ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ করেছিলেন পু-হা-দীন নামক এক মুসলিম প্রচারক, যাঁর পরিচয় হিসেবে বলা যায়, তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদের ষোড়শ প্রজন্মের বংশধর।
চীনা মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতে, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) কুয়াংচৌ শহরে মারা যান। সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। তবে আরব বিদ্বানরা ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁরা বলেন, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) – এর মত্যু হয় এবং তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় মদিনায়। কারণ মদিনাতেও সাদের একটি সমাধি রয়েছে। ফলে একটি হল সাদের প্রকৃত সমাধি, অপরটি প্রতীকী। কিন্তু এই দুটির মধ্যে কোনটি আসল ও কোনটি প্রতীকী তা কেবল আল্লাহ জানেন।
যাই হোক, ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এ কথা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, চীনে ইসলামের বিস্তার হয়েছিল খুবই শান্তিপূর্ণ ভাবে। আজও চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মুসলিমদের বাস রয়েছে, এমনকী তিব্বতের বহু প্রত্যন্ত এলাকাতেও মুসলিমদের উপস্থিতি রয়েছে।