ডাক্তার,মহাকাশচারী, ডেলিভারি বয়- এক মানুষ নানা রূপ

মহাকাশচর্চা বা জ্যোতির্বিদ্যা উচ্চতর বিজ্ঞানের একটি অন্যতম প্রধান বিষয়। রাশিয়ার চন্দ্রাভিযান নভোঃবিজ্ঞানের এক নতুন দ্বার খুলে দেয় পৃথিবীর বুকে। এর পর আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ একে একে উদ্যোগ নিতে থাকে মহাকাশের বিপুল রহস্য ভেদ করার জন্য। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে থাকে জাপান, চিন এবং ভারত।
মহাকাশযানে চড়ে পৃথিবী ছাড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের বলা হয় মহাকাশচারী বা নভোশ্চর। এরকমই এক মালয়েশিয় নভোশ্চরের নাম ডাঃ শেখ মুজাফফর শুকর। তাঁর মহাকাশভ্রমণের সুযোগ এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে বহু চমকপ্রদ তথ্য আছে। প্রাথমিক ভাবে ডাঃ শুকর একজন অর্থোপেডিক সার্জন, প্রথমে ভারতের মণিপাল থেকে কস্তুরবা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন এবং উচ্চতর পড়াশোনা করেন কেবাংসান বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়ালালামপুর থেকে।
ডাক্তার থেকে নভোশ্চরঃ
২০০৭ সালে মালয়েশিয়া রাশিয়ার থেকে ১৮ টি ফাইটার জেট কেনে, এই চুক্তির অন্তর্গত ছিল একজন মালয়েশীয় ব্যক্তির মহাকাশ ভ্রমণ। ১১০০০ প্রার্থী এই সুযোগের জন্য আবেদন করেছিলেন সেখান থেকে ডাক আসে দুইজনের। রাশিয়াতেই ১৮ মাসের ট্রেনিং পর্ব এবং মেডিকেল টেস্ট হওয়ার পর, রাশিয়া ডাঃ শুকরকে নির্বাচন করেন মহাকাশ যাত্রার জন্য। তিনি কিন্তু প্রথমে ছিলেন ডাক্তার।
এই মহাকাশ যাত্রার গন্তব্য ছিল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে দশ দিনের ভ্রমণ। রাশিয়ার উদ্যোগে হওয়া এই অভিযান শুরু হল ২০০৭ সালের অক্টোবরের ১০ তারিখে। বাইকোনার কসমোড্রোম, কাজাখস্তান থেকে সয়ুজ টিএমএ– ১১–তে চড়ে কমান্ডার ইউরি মালেনচেনকো এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার পেগি হুইটসনের নেতৃত্ব যাত্রা শুরু হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের দিকে। ডাঃ শুকর হলেন প্রথম মালয়েশীয় মহাকাশচারী। কাহিনী এখানেই শেষ নয়, ডাঃ শুকুর মুখোমুখি হলেন আরও এক সমস্যার।
সময়টা ছিল রমজানের শেষ কয়েকটা দিন, কিন্তু মহাকাশে নামাজ পড়া বা রোজা রাখা যায় কীভাবে? কীভাবে ঠিক হবে কেবলামুখ অথবা ইফতার–শেহরীর সময়? কাজে নেমে পরল মালেয়শিয়ার জাতীয় ফতোয়া কাউন্সিল। বহু আলোচনা, তর্ক–বিতর্কের পর ইসলামী রীতিনীতি মহাকাশে পালন করার গাইডবুক তৈরি হলো। আঠারো পাতার বইটিতে ছিল ডাঃ শুকুরের সমস্ত সমস্যার উত্তর। তিনি হলেন প্রথম মুসলমান যিনি রমজান এবং ঈদ পালন করলেন মহাকাশে। ইসলামের এক নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হলো এর সাথে সাথে।
ডাক্তার ও মহাকাশে গবেষণাঃ
দশ দিনের সফরে ডাক্তার শুকুর অনেকটা ভিডিও করে রেখেছেন যা এখনও ইউটিউবে দেখা যায়। স্পেস স্টেশনে কাটানো সময়ের বেশিরভাগটাই তিনি গবেষণা করেছিলেন লিভার ক্যানসার ও লিউকিমিয়ার (রক্তের ক্যানসার) কোশ নিয়ে। তাঁর এই গবেষণা যা তিনি পরবর্তীকালেও করেছেন, তা চিকিৎসাবিজ্ঞানকেও প্রভূত সাহায্য করেছে।
২১ অক্টোবর তিনি ফিরে আসেন পৃথিবীতে। নামার আগে স্পেসক্র্যাফ্টে যান্ত্রিক গোলযোগ হওয়ায় নির্ধারিত জায়গা থেকে ৩৪০ কিমি দূরে ল্যান্ড করানো হয়। সফর চলাকালীন এবং তার আগে ডাক্তার শুকুরের প্রশিক্ষণ কোনো নভোশ্চরের থেকে কম ছিলনা তাই নাসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা তাঁকে নভোশ্চর বলেই সম্বোধন করেছেন।
বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়াতেই নিজের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতিতে তিনি নিজের তরফ থেকে মানুষকে সাহায্য করতেও কার্পণ্য করেননি। নিজের রেস্তোরাঁর খাবার ডেলিভারি করে বেরিয়েছেন শহরজুড়ে।
ডাক্তার শেখ মুজফফর শুকরের মতো প্রতিভাবান, গুণী এবং অমায়িক মানুষ আমাদের সমাজকে আরও এক ধাপ অগ্রগতির দিকে নিয়ে যান। তাঁদের মতো মানুষদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানায় মানবসমাজ।