দুনিয়ার ছায়া এবং মায়া ত্যাগ করুন

“দুনিয়া ছায়ার মতো। আপনি যদি এটি ধরার চেষ্টা করেন তবে আপনি কখনই সক্ষম হবেন না। আর আপনি যদি এটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তবে এটি আপনাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হবে।” (ইবনুল কাইয়্যিম)
এই উক্তিটি বিখ্যাত ইমাম, আধ্যাত্মিক হৃদয়ের চিকিৎসক ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওযিয়াহ (রহঃ) করেছিলেন। এটি এমন একটি বিখ্যাত উক্তি যা আমাদের বেশিরভাগ পাঠকই কোথাও না কোথাও পড়েছেন। তবে, আমরা কি কখনও এটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছি? কেন ইমাম দুনিয়াকে উদাহরণস্বরূপ ছায়ার সাথে তুলনা করলেন? দুনিয়ার মায়া মোহ কাটানো নিয়ে কী বলেছেন তিনি?
দুনিয়ার ছায়া কী?
আলো যখন কোনো বস্তুর উপর পড়ে তখন সেই বস্তুর ছায়া উৎপন্ন হয়। সংক্ষেপে, ছায়া হলো এমন একটি জিনিস যা বাস্তব নয়, শুধুমাত্র নকল একটি চিত্রকল্প।
ছায়া থেকে প্রাপ্ত প্রথম শিক্ষা হল, দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তা সবই নকল। এটি শুধুমাত্র একটি ছায়া এবং এটির পিছনে যে ছুটে চলেছে সে মত্ত ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
দ্বিতীয় যে শিক্ষাটি আমরা ছায়া থেকে পাই তা হল, এটি নির্দেশ করে যে কিছু একটা বাস্তবে বিদ্যমান আছে। ছায়ার অস্তিত্ব একটি আসল শরীরের অস্তিত্ব নির্দেশ করে। আর দুনিয়ার অস্তিত্ব পরকালের অস্তিত্ব নির্দেশ করে।
তৃতীয় যে শিক্ষাটি আমরা পাই তা হল, এটি অস্থায়ী। ছায়া কেবল মাঝে মাঝে দেখা যায়, তবে ছায়া থাকুক বা না থাকুক শরীর সর্বদাই বিদ্যমান থাকে। একইভাবে পরকালের জীবন স্থায়ী কিন্তু দুনিয়া অস্থায়ী।
চতুর্থ শিক্ষাটি হল ছায়ার মূল্য এবং উপকারিতা খুবই কম। অবশ্য এমনও সময় রয়েছে যখন ছায়াও উপকারে আসতে পারে তবে সাধারণত এটি আমাদের তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করে না। তেমনিভাবে দুনিয়ারও কিছু উপকারিতা আছে কিন্তু আখিরাতের তুলনায় তা খুবই নগণ্য।
দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা
এই হল ছায়ার সাথে দুনিয়ার তুলনা থেকে প্রাপ্ত ৪টি শিক্ষা। তবে এটি ঐ উক্তি থেকে প্রাপ্ত পরিপূর্ণ শিক্ষা নয়। সুতরাং আসুন আবার উক্তিটির দিকে ফিরে আসা যাক। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেছেন যে, দুনিয়া সেই ব্যক্তিকে অনুসরণ করে যে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং এটিই সত্য কথা।
আল্লাহ কুরআনে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হলঃ
“তোমারা যদি কৃতজ্ঞ হও তবে তোমাদের নেয়ামতকে বাড়িয়ে দেওয়া হবে” (আল কুরআন ১৪:৭)
তাই দুনিয়ার পিছনে না দৌড়িয়ে, দুনিয়াকে ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের যা কিছু আছে তার জন্য যদি আমরা কৃতজ্ঞ হই, তবে আল্লাহ আমাদের দুনিয়াকে আরও বৃদ্ধি করে দেবেন। সুতরাং এরপর থেকে, অর্থাভাবের অভিযোগ না করে আল্লাহ আমাদের যে পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ থাকব এবং এতে তিনি আরও বৃদ্ধি করে দেবেন। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা কিছু না করে বসে থাকব। বরং আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে চেষ্টা করে আমরা যা পাব তার জন্যই আমরা আল্লহর শুকরিয়া আদায় করব।
দুনিয়াকে ফিরিয়ে দিন
দুনিয়া একটি হাতিয়ার। তবে আমরা এটি কীভাবে ব্যবহার করি এবং এর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন এটি তার উপর নির্ভর করে। দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অর্থ এই নয় যে, আমরা এর ব্যবহার বন্ধ করে দিব। তবে এটিকে আমাদের উদ্বেগের বিষয় বানানো যাবে না।
আমাদের উচিত পরকালকে উদ্বেগের বিষয় বানানো। পার্থিব কাজ যেন আমাদেরকে ইবাদত থেকে ফিরিয়ে না রাখে। সকল কাজে আল্লাহ এবং তার হুকুম যেন আমাদের সামনে থাকে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ বলতেন, তারা দুনিয়া থেকে পলায়ন করেন কিন্তু দুনিয়া তাদের পিছু ছাড়ে না। অনেক ইবাদতগুজার সাহাবী ছিলেন যারা সম্পদের দিক থেকে অনেক ধনী ছিলেন। কিন্তু এই সম্পদ তাদেরকে আল্লাহ থেকে বিমুখ করতে পারেনি। এটা এ কারণে হয়েছিল কারণ তারা দুনিয়া বিমুখ ছিলেন।
আমরা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি বিখ্যাত হাদিস দিয়ে এই আলোচনাটি শেষ করছি। তিনি বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি আখেরাতকে তার লক্ষ্য বানায়, আল্লাহ তার অন্তরকে ধনী বানিয়ে দেন এবং তার সকল কাজকে সহজ করে দেন এবং দুনিয়া তার পায়ে এসে হাজির হয়। আর যে ব্যক্তি দুনিয়াকে তার লক্ষ্য বানায়, আল্লাহ দারিদ্র্যতাকে তার চোখের সামনে এনে দেন এবং তার সকল কাজকে অগোছালো করে দেন এবং যতটুকু দুনিয়া তার জন্য নির্ধারিত ততটুকুই সে পায়, কিন্তু আখিরাতে তার কোনো অংশ নেই”। (সুনানে তিরমিযী)