পার্সিয়া থেকে উৎপন্ন ‘পোলো’ এখন পশ্চিমের অভিজাতদের খেলা

ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে ফরাসি শব্দ ‘ডিস্পোর্টস’ থেকে স্পোর্টস শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হল ‘অবসর’। সুপ্রাচীন কাল থেকেই খেলাধুলো বা শরীরচর্চার মতো বিষয়গুলোকে প্রাত্যহিক জীবনাচরণের একটা বিপরীত ধারা এবং অবসরের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আমেরিকানরা ‘স্পোর্টস’ শব্দটিকে একধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে দেখতেই পক্ষপাতী ছিলেন। তবে ভাষাতাত্ত্বিকদের অনেকে আবার বলেছেন ফার্সি শব্দ অনুযায়ী স্পোর্টসের ভাবার্থ দাঁড়ায় ‘জয়ী’, আর চিনদেশে স্পোর্টসের রূপকে আদতে শরীরচর্চা এবং প্রশিক্ষণকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খেলা বা স্পোর্টসের আদিশব্দরূপের কথা বলা প্রসঙ্গে শতাব্দি প্রাচীন একটি খেলা ‘পোলো’ সম্পর্কে দু-চারটি কথা বলব।
জটিল খেলা পোলো
পোলো সম্ভবত প্রাচীনতম একটি খেলা, একইসঙ্গে এই খেলার পদ্ধতিও বেশ জটিল। ঐতিহাসিকদের ধারণা অনুসারে শতাব্দিপ্রাচীন কালে যাযাবর যোদ্ধাগোষ্ঠীদের মধ্যে পোলো খেলার চল ছিল। ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্যকে সামনে রেখে বলা যায় প্রাচীন ইরানিয় উপজাতি গোষ্ঠীর দ্বারা এই খেলার প্রচলন শুরু হয়। ইরান থেকেই এশিয়া মহাদেশ এবং পরে অন্যান্য উপমহাদেশীয় দেশগুলোতে এই পোলো খেলার প্রবর্তন শুরু হয়। এই খেলাটি পরিচালনার জন্য একটি বল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই বলের সূত্র ধরে খেলাটির নামকরণ হয়েছে।
তিব্বতি শব্দে ‘ফোলো’-র অর্থ হল বল বা বলগেম। সবথেকে প্রাচীন এবং স্মরণযোগ্য পোলো খেলাটি হয়েছিল ৬০০ খ্রিপূর্বাব্দে তুর্কোমান এবং পার্শিয়ানদের মধ্যে। তবে, এই বিষয়টিও তর্কসাপেক্ষ। তাত্ত্বিকদের মতে দারয়ুস দ্য গ্রেটের সম্রাজ্যের আগে পোলো খেলার প্রচলন ছিল। সুতরাং ইরানের সঙ্গে এই খেলার এক প্রাচীন সংযুক্তি অবশ্যই রয়েছে। অন্যদিকে আবার বহু তাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকদের মতে পোলো বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে চীন এবং মঙ্গোলদের দ্বারা। মোটের উপরে এই তর্কের সুনিশ্চিত কোনও সমাধান নেই। কিন্তু বহুপূর্বে লেখা বিভিন্ন পার্সিয়ান সাহিত্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে এই খেলার উল্লেখ আমরা পাই। তাছাড়া পোলো খেলার সাধারণ নিয়মাবলী পর্যবেক্ষণ করে অনেক ঐতিহাসিকই এই খেলার প্রাচীন উৎস পার্সিয়া বলে মান্যতা দিয়েছেন। তাই পার্সিয়ার হাত ধরেই সমগ্র বিশ্বে পোলোর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
সাহিত্যে পোলো
ইরানের অন্যতম বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ফিরদৌসির লেখাতেই এসেছে এই খেলার কথা। দশম শতকে রচিত ‘শাহনামেহ্’ (দ্য বুক অফ কিংস) গ্রন্থে তিনি পোলো খেলার রাজকীয় ঐতিহ্যের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আরও দুটি কথা বলা প্রয়োজন। পোলো খেলা মোটেই সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির খেলা নয়, এই খেলার সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে একধরনের আভিজাত্যবোধ। অভিজাতশ্রেণির খেলা হয়ে ওঠার মূল কারণ দুটি। এক, পোলো খেলার জন্য ঘোড়া চালানোর বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে, যা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। দুই, নিয়মিত চর্চার জন্য ব্যক্তিগত ঘোড়া এবং সংলগ্ন আস্তাবল রাখাটাও জরুরি। সাধারণ পরিবারের পক্ষে এই ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ কিঞ্চিৎ বিলাসিতারই নামান্তর বটে। তাই সেইসময়ে রাজাবাদশাহরা এই খেলার চর্চা বেশি করতেন, পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ড এবং অন্যান্য রাজপরিবারে এই খেলার চল প্রত্যক্ষ করা গেছে।
ফিরদৌসির কাহিনিতেও আমরা দেখব পৌরাণিক তুরানিয়ান বাহিনী এবং সাম্রাজ্যের প্রথম শতাব্দীর কিংবদন্তি পার্সিয়ান রাজকুমার সিয়ওয়াশের অনুসারীদের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের বর্ণনা। এই বর্ণনাতে খেলার বর্ণনার পাশাপাশি রাজকুমার সিয়ওয়াশের একাগ্রতাকেও বিশেষ করে বাহবা জানানো হয়েছে। ফিরদৌসি সাসানীয় সম্রাট দ্বিতীয় সিপোর সম্পর্কেও লিখেছেন, যিনি মাত্র সাত বছর বয়সে পোলো খেলতে শিখেছিলেন। এই দশম শতকেরই অন্য একজন ঐতিহাসিক দিনওয়ারি তাঁর লেখাতে পোলোর সাধারণ নিয়মাবলী সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। খেলা চলাকালীন একজন খেলোয়াড়ের দৃঢ়তা, মনোসংযোগ এবং একাগ্রতা বজায় রাখাই হল আসল লক্ষ্য। দশম শতাব্দীর সময় জিয়ারিদ রাজবংশের ইরানী রাজা ক্বাবস এবং গনবাদ ই কিবুস টোম্ব পোলো খেলাটির সম্পর্কে বেশ কিছু বিধি নিয়মের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
ফারসি কবি ওমর খৈয়ামের রুবাইতে পোলোর প্রসঙ্গ আমরা পেয়ে থাকি। তবে সেখানে কবির লেখাতে দার্শনিক ব্যাখ্যাই বেশি পরিমাণে প্রকাশ পেয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীর ইরানী কবি নেজ়ামি পোলো মাঠে সাসানীয় সম্রাট দ্বিতীয় পারভিজের দক্ষতার কথা বর্ণনা প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন, সম্রাট পত্নী শিরিনের এক প্রেম গাথা।
জাপান থেকে তুরস্ক, পোলোর ব্যাপ্তি
সাহিত্যের প্রসঙ্গসূত্রে, ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্র ধরে চললে আমরা দেখতে পাব প্রাচ্য থেকে জাপান এবং কনস্ট্যানটিনোপলেও গেমটির জনপ্রিয়তা বেড়েছে ক্রমান্বয়ে। এরপরে অবশ্য ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম বিজয়ের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে খেলাটি প্রচলিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে, স্থানীয় রাজা ও রাজকুমাররা মুসলিম শাসকরা খেলাটি গ্রহণ করেছিলেন। লাহোরের আনারকলি বাজারের নিকটে ধুলাবালিযুক্ত গলিতে ১৩তম শতাব্দীর রাজা সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবাকের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী খেলা চলাকালীন তিনি তাঁর ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। চীনাদের কাছে অবশ্য পোলো ছিল বহু শতাব্দী ধরে একধরনের রাজকীয় বিনোদন। চেঙ্গিস খান এবং তাঁর সৈন্যবাহিনি এশিয়া মাইনর এবং ইরান প্রদেশ জয় করার সময়ে এই খেলার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে বলে একধরনের প্রাথমিক ধারণা করা হয়। মূলত এই শিক্ষণপ্রণালীতে অবশ্যই ইরানীয় যোগসূত্র অবশ্যই রয়েছে।
বৃহৎ পিচ
এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের কথা উল্লেখ করতে হয়। পোলো পিচের প্রকৃত আকার শুনলে রীতিমতো চমকে উঠতে হয়! প্রায় দশ একরের মতো জায়গা জুড়ে পোলো পিচ তৈরি হয়ে থাকে, একসঙ্গে নয়টি ফুটবল পিচ যদি কল্পনা করেন তাহলে তার সমতুল্যই বটে। পোলো খেলার প্রথম এবং সবথেকে প্রাচীন পিচটি তৈরি হয়েছিল ইরানের আলি গাপু প্যালেসের সামনে। সময়কাল ১৫০০ দশকের কাছাকাছি। ইরানের একটা প্রাচীন শহর ইস্পাহানে এটি রয়েছে। বর্তমানে এটি পোলো খেলার পিচ হিসেবে ব্যবহৃত হয় না বরং এটিকে ব্যবহার করা হয় উদ্যানরূপে। এই পিচের সঙ্গে সংলগ্ন ‘রান অফ এরিয়া’ নামক স্থানটিকেও আর আগের মতো ব্যবহার করা হয়ে থাকে না। এই বিষয়ে আলোচনা করার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে খেলাটির জনপ্রিয়তা বেড়েছিল উনিশ শতকে কাজেই ওই দশকে দাঁড়িয়ে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করাটাও নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত।
পরবর্তীসময়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে খেলাটির জনপ্রিয়তা বিশেষভাবে বাড়তে থাকে। ভারতবর্ষে আগত ব্রিটিশ নৌসেনাদের হাত ধরে এই খেলার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডে। ১৮৬৯ সালে প্রথম ব্রিটেনে পোলো খেলাটি হয়েছিল। সেই সময়ে জনপ্রিয় এক সংবাদমাধ্যম পত্রিকাতে এই খেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘ঘোড়ায় চড়া হকি’ এই নামে।
নথি প্রমাণ
তবে উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত বলা ভাল ব্রিটিশ কলোনিয়ান সাম্রাজ্য প্রসারের আগে পর্যন্ত এই খেলার লিখিত বিধি-নিয়মের কোনও প্রকার হদিশ পাওয়া যায় না। পোলো খেলার নিয়ম সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন জন ওয়াটসন। তিনি ছিলেন আইরিশ ক্যাপ্টেনম্যান এবং ব্রিটিশ মাউন্টেন সৈন্যবাহিনীর একজন উচ্চআধিকারিক। মূলত তার হাত ধরেই এই খেলার নিয়ম নীতি সংক্রান্ত বিধি প্রনোদিত হয়। নিয়মগুলো মোটামুটি ১৮৭৪ সময়ের মধ্যে বেশ কিছুবার সংশোধিত হয়েছিল।
খেলার ব্যাকরণ
পোলো খেলার একটা সুনির্দিষ্ট রীতি রয়েছে উন্মুক্ত মাঠে খেলা হলে ঘোড়ার পিঠে প্রতিটি দল থেকে চারজন করে অংশগ্রহণ করতে পারবেন এবং যদি বদ্ধ স্থানে খেলা হয় তাহলে তিনজন করে খেলায় অংশগ্রহণ করবে। ঘোড়ার উপরে খেলোয়াড়রা বসবেন এবং তাদের ডান হাতের স্টিক দিয়ে বলটিকে আঘাত করে গোলপোস্টের দিকে পাঠানোর চেষ্টা করবেন। ফুটবলে যেমন করে পায়ের ব্যবহার করে বলটিকে গোলপোস্টের দিকে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি রয়েছে। নিজেদের টিম মেটদের মধ্যে বল পাস করারও পদ্ধতি রয়েছে। তবে পোলো খেলার ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল লাইন অফ বল, লাইন অফ বল মেনটেন করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়টি ফাউল বলে গণ্য হবে এবং তার পরিবর্তে অন্য টিমের খেলোয়াড় বল পরিচালনার এবং গোল করবার সুযোগ পাবে। পোলো খেলা সম্পূর্ণ হয় ৪, ৬ বা ৮ চুক্কাস দ্বারা। প্রতিটি চুক্কাসের শেষে বাঁশি বাজানো হয় এবং ৩০ সেকেন্ডের মতো বিরতি দেওয়া হয়।
জেতার শর্ত
এই হিসেবে যদি বিজয়ী দল না পাওয়া যায় তাহলে আবার ৪-৮ চুক্কাস খেলা হয়ে থাকে। পোলো খেলার বিভিন্ন রীতি প্রসঙ্গে আরও একটা বিষয় অবশ্যই বলা উচিত। প্রতিটি খেলোয়াড়রই আলাদা আলাদা ভূমিকা রয়েছে এবং সেই অনুযায়ী তারা নিজেদের মধ্যে কোঅরডিনেশনও করে থাকে। অফেনসিভ(যিনি মূলত গোল করার চেষ্টা করেন, এখানে তিনিই প্রধান), দ্বিতীয় জনও গোল করার চেষ্টা করেন এবং প্রথম জনের ঠিক পিছনেই নিজের ঘোড়াটি চালনা করেন, তৃতীয় জনের কাজটি হল বল পাস করা প্রথম এবং দ্বিতীয় জনের মধ্যে, চতুর্থ জনকে বলা হয় লাস্ট লাইন অফ ডিফেনসর, তার মূল কাজই হল প্রথম জনের খেলার পদ্ধতিকে মসৃণ করা, বিপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে বেশি সংখ্যক গোল করতে সাহায্য করা। তবে নিয়মের ত্রুটি হলে রয়েছে পেনাল্টি হিট এবং পেনাল্টি গোল। এইভাবেই পোলো খেলাটি সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে আধুনিক সময়ে আরও বেশ কয়েকটি নীতি নিয়মের গ্রহণ-বর্জন হয়েছে এই খেলাতে।
