প্রযুক্তি এবং হজ কি পরস্পরবিরোধী ?

হজকে সারা বিশ্বের মুসলিমদের আরও কাছে নিয়ে আসার জন্য নতুন প্রযুক্তি, যেমন লাইভ ফিড, স্ন্যাপচ্যাট এবং আইফোনের বিভিন্ন অ্যাপ অনেকটাই সাহায্য করছে। আসলে, প্রযুক্তি সব সময়েই হজযাত্রার বিকাশে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম হজ যাত্রার ট্র্যাভেল প্যাকেজ ১৮৮০ সালে ব্রিটিশরা চালু করে, আর তাদের ট্র্যাভেল এজেন্টরাই ক্রমশ ভারতীয় উপমহাদেশের হজযাত্রীদের সরকারী এজেন্ট হয়ে ওঠে।
প্রযুক্তি এবং হজ, এই দুটির সমান্তরাল বেগ সারা বিশ্বে মুসলিম দের তো বটেই অমুসলিমদের মক্কা এবং তীর্থযাত্রা সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলেছে। এরই মধ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্য ১৯০৮ সালে হিজাজ রেলওয়ে চালু করে, যেটা দামাস্কাস থেকে মদিনা পর্যন্ত চলত। এর ফলে হাজীদের ৪০ দিন ধরে পদব্রজে যাত্রা করতে হত না, যা এর আগে বহু ধর্মপ্রাণ মুসলিমের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। শিল্পযুগের ফলে পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে হজ করতে আসা যাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। এই প্রবণতা এখনও চালু রয়েছে, এবং বিশ্বজুড়ে বিমান পরিবহণ সহজসাধ্য হওয়ার সাথে সাথে হাজীদের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। ১৯৫০ সালে যেখানে হজযাত্রীর সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ, সেখানে ২০১৭ সালে তা বেড়ে ২৩ লক্ষ হয়েছে।
প্রযুক্তি এবং হজ: সহজলভ্যতা
আজকের যুগে প্রযুক্তি শুধু হজযাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছতে সাহায্য করার মধ্যেই থেমে থাকেনি, প্রযুক্তি তাদের পৌঁছানোর পরও সাবধানে থাকতে এবং সংযুক্ত থাকতে সাহায্য করছে । সৌদি সরকারের দেওয়া পরিধানযোগ্য ব্রেসলেটের ভিতরে পরিধানকারীর সব তথ্য জমা থাকে, কোনও ধরনের শারীরিক অসুবিধার ক্ষেত্রে, বা নিজের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে বা যে কোনও ধরনের বিপদের সময়, এটি খুবই সাহায্যকারী।
হজযাত্রীদের পরিবার এবং পরিজনেরা স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের হাল হকিকত জানতে উৎসুক থাকেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যদি আপনার কোনও আত্মীয়ের অবস্থানে গত কয়েক দিনে কোনও রকম পরিবর্তন না হয় বা তাঁরা যদি কোনও কারণ না থাকা সত্ত্বেও মুজদালিফায় থাকেন, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন নিশ্চিত ভাবেই কোনও গন্ডগোল হয়েছে। তৎক্ষণাৎ আপনি সেই আত্মীয়ের সঠিক অবস্থান জানার জন্য সম্পর্কে সাহায্য চাইতে পারবেন। বিশেষ করে বয়স্ক হজযাত্রীদের জন্য এটি খুবই কার্যকর।
হজযাত্রী এবং তাদের বাড়ির লোক, এই দুই পক্ষের কথা মাথায় রেখেই আরব নিউজ হজ অ্যাপের মতো বিভিন্ন ধরনের মোবাইল অ্যাপ বানানো হয়েছে। তাঁদের লোকেশন জানানোর সাথে সাথে, এটা হজযাত্রীদের হজ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক খবর দেয়, যাতে তারা বিপন্মুক্ত এবং সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সর্বদা ওয়াকিবহাল থাকেন।
প্রযুক্তি এবং হজ: অমুসলিমদের সুবিধার্থে
যে কোনও অমুসলিম ব্যক্তি (যাঁদের মক্কায় প্রবেশাধিকার নেই) যদি হজের সৌন্দর্য্য এবং সম্প্রীতি দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকেন, তার জন্যও সোশ্যাল মিডিয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একবার স্ন্যাপচ্যাট মক্কার লাইভ একটি স্টোরি চালিয়েছিল, যা অসংখ্য অমুসলিমকে ইসলামের প্রতি ইতিবাচকভাবে আকৃষ্ট করে তুলেছিল। হজযাত্রীরা যখন নিজেদের পরিচয় জানিয়েছিলেন এবং তাঁরা কেন হজে এসেছেন তার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন, তা দেখে বহু অমুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গিয়েছিল।
সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও, হজের কর্মকর্তারা অন্য ডিজিটাল স্পেস ব্যবহার করে থাকেন হজের জন্য। তাঁরা যাত্রা শুরু আগে হজযাত্রীদের বিভিন্ন বিষয় জানানোর জন্য পোর্টালও বানিয়েছেন। SaudiWelcomesTheWorld.org এবং Hajj2017.org -এ হজযাত্রীরা কী দেখতে পাবেন, তা জানানোর জন্য মক্কার ভার্চুয়াল ট্যুরের ব্যবস্থা রয়েছে, যার মাধ্যমে হজে আসতে ইচ্ছুক মুসলিমরা জেনে নিতে পারবেন যে, হজের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁরা কী কী প্রত্যাশা করতে পারেন।
আধ্যাত্মিক আপস হচ্ছে কি?
যদিও, এমন নানাবিধ ইতিবাচক বিষয় উপস্থিত থাকার পরেও, প্রযুক্তি এবং হজের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক পুরোপুরি মসৃণ নয়। কারণ ভিডিও কল এবং সেল্ফি তোলার হিড়িক হাজীদের আধ্যাত্মিক ভাব কমিয়ে দিতে পারে। স্মার্টফোন এই পৃথিবীর দখল নেওয়ার আগে যাঁরা হজ করেছেন, তাঁরা যদি বর্তমানে পুনরায় হজে যান, তাহলে তাঁরা দুই সময়ের পার্থক্যটা খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারবেন।
তাছাড়াও, অনেকেই এটা ভুলে যান যে, হজ করতে যাওয়া মানে শুধুই বিলাসবহুল প্লেনে চাপা, দামী হোটেলে কয়েক দিন বসবাস বা মিডিয়ার নজরে থাকা নয়, হজের প্রকৃত অর্থ হল হল আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা। হজ হল অত্যন্ত গভীর
ধর্মীয় প্রতীক এবং আল্লাহের প্রতি সমর্পণের প্রকাশ। সোশ্যাল মিডিয়ার উগ্রতায় মত্ত হয়ে উঠলে এই মূল বিষয়টি বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
পবিত্রতার আগে প্রযুক্তি নয়
কাবা’র চারপাশে প্রদক্ষিণ করার সময় যদি আশপাশের সকলে সমানে ফোনে বা ভিডিও কলে কথাবার্তা বলতে থাকে, বা অবিরাম লোকজনের ফোন বাজতে থাকে- তাহলে এত ধরনের শব্দ অন্য হাজীদের মনোনিবেশ করতে এবং আল্লাহের সান্নিধ্য উপলব্ধি করতে বাধা প্রদান করে। আর যারা হজে গিয়ে আল্লাহের চিন্তার বদলে ফোন নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, তাঁদের হজ করা হয় শুধুমাত্র লোককে বলা ও দেখানোর জন্য।
তাই প্রযুক্তির ব্যবহার ঠিক ততটাই কাম্য, যতটা হজ এবং হাজীদের খবরাখবরের জন্য প্রয়োজন। হজযাত্রার পবিত্রতা বজায় রাখার জন্যই প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি।