ফিকহের সংজ্ঞা ও ফিকহ সংকলনের প্রয়োজনীয়তা

ফিকহের সংজ্ঞা জানতে গেলে আগে আমাদের বুঝতে হবে ইসলাম মানুষকে তার জীবন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। যা তাদের সকল চিন্তা, আচরণ ও কর্মকাণ্ডের মূলভিত্তি। এরূপ কোনো ভিত্তি এমন একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার অস্তিত্বের দাবী করে যার প্রতিটি অংশ হবে সকল ক্ষেত্রে মূলের অনুগামী ও তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব, ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রেও এমন একটি শাখার আর্বিভাব হওয়া অনিবার্য ছিল যা ব্যবহারিক জীবনের এই চাহিদাকে সম্পূর্ণ করবে। ইলমুল ফিকহ বা ফিকহ শাস্ত্র হচ্ছে ইসলামী জ্ঞানের সেই বিশেষ শাখা। এই বিশেষ শাখার গুরুত্ব বুঝিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামও বলেছেন,
“প্রত্যেক জিনিসেরই একটি স্তম্ভ রয়েছে। আর দ্বীন ইসলামের স্তম্ভ হলো ফিকহ।”
ফিকহের সংজ্ঞা
ফিকহ আরবি অর্থ। যার আভিধানিক অর্থ গভীর জ্ঞান। ইসলামী জ্ঞান যেরকমভাবে কুরআন ও হাদিসের উপর নির্ভরশীল এবং তেমনি অনেকাংশে ফিকহের উপরও নির্ভশীল। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ওহী নাযিলকালে কুরআনে ফিকহ্ চর্চ্চার কথাও বলা হয়েছে। এবং হাদিসের রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফিকহ চর্চার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন।
ফিকহের সংজ্ঞা জানতে গেলে আমরা দেখতে পাই আভিধানিক ভাবে ‘ফিকহ’ বলতে যে কোন বিষয়ের গভীর জ্ঞান। তবে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ও বিভিন্ন হাদীসে ‘ফিকহ’ বলতে সুনির্দিষ্ট ভাবে দ্বীনের গভীর জ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে। এ কারণেই ইসলামের প্রথম যুগে ‘ফিকহ’ বলতে ইসলামী জ্ঞানের বিশেষ কোন শাখাকে বোঝানো হতো না বরং সামগ্রিক ভাবে গোটা দ্বীনকেই বোঝানো হতো।
কিন্তু পরবর্তীকালে দ্বীনের সকল শাখা স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয়ে বিস্তৃত হতে থাকলে ‘ফিকহ’ শব্দটি কুরআন-সুন্নাহ থেকে মানুষের ব্যবহারিক জীবনের হুকুম আহরনের যে বিশেষ ক্ষেত্র কেবল তার জন্যই সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। অতএব, ইসলামী শরীয়াহর পরিভাষায় ফিকহ বলা হয় ইলমের সেই বিশেষ শাখা যা শরীয়াহর সকল প্রামান্য উৎস থেকে শরীয়াহর শাখা-প্রশাখা সম্পর্কিত বিধি বিধান উদঘাটন করে।
ইমাম শাফি’ঈ(রহঃ) ফিকহের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
“ইসলামী শরীয়াহর বিস্তারিত প্রামাণাদি থেকে শরীয়াহর ব্যবহারিক বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাকে ফিকহ বলা হয়”
সংক্ষেপে বলা যায় ‘ফিকহ’ হচ্ছে ইসলামী আইন কানুন এবং এ সম্পর্কিত বিশেষ ইলম বা জ্ঞান। আর এ ইলমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সফলতা লাভ করা।
যে সকল কারণে ফিকহ সংকলনের প্রয়োজন হয়
১। যখন বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই
কুরআন-হাদিসে কোনো কোনো বিষয় এমন রয়েছে যেগুলির কেবলমাত্র মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছাড়া কখনও কখনও সাধারনের পক্ষে তা উপলব্ধি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এসকল মূলনীতির আলোকে বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য ফিকহ সংকলনের প্রয়োজন দেখা দেয়।
২। বিপরিতমুখী আয়াত
কুরআনের কোনো কোনো স্থানে বাহ্যত দৃষ্টিতে পরস্পর বিপরীতমুখী আয়াত দেখা যায়। যেমন এক জায়গায় ইরশাদ হয়েছে,
“আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে যাবে, তখন সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা। (২:২৩৪)
আবার অন্যস্থলে ইরশাদ হয়েছে,
“তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাদের ইদ্দত হবে তিন মাস। আর যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে। গর্ভবর্তী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তানপ্রসব পর্যন্ত।” (৬৫:৪)
এসকল বিষয়ের সমাধানের জন্য ফিকহ শাস্ত্রের প্রয়োজন।
৩। হাদিসের বিপরিতমুখিতা
কখনও কখনও কুরআন-হাদীসে বাহ্যত দৃষ্টিতে বিপরীতমুখিতা দেখা যায়। যেমন আল্লাহ বলেন, “কাজেই কুরআনের যতটুকু তোমাদের জন্য সহজ, ততটুকু তেলাওয়াত করো।” (৭৩:৪)
আবার হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে, “সুরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না।” (বুখারী)
এসকল সংকট নিরসনে ফিকহের প্রয়োজন দেখা দেয়।
৪। পরস্পরবিরোধী হাদিস
মাঝে মধ্যে বাহ্যত দৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী হাদীসসমূহের মধ্যকার সঠিক সমাধানের জন্য ফিকহের প্রয়োজন দেখা দেয়। যেমন, এক হাদীসে বলা হয়েছে, “সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না।”
আবার আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, “ইমামের কিরআত-ই হল মুক্তাদীর কিরআত।”
এখন জামআতের সাথে সালাত আদায় করলে তখন কি ফাতিহা তিলওয়াত করতে হবে কি হবে না তার সমাধানের জন্য ফিকাহের প্রয়োজন পড়ে।
৫। যুগোপযোগী বিধান
স্থান, কাল ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিত্য নতুন সমস্যার উদ্ভব হতেই থাকে। এখন ইসলাম যেহেতু পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা তাই সকল সমস্যার সমাধান কুরআন-হাদীসের মূলনীতি অনুযায়ী দেওয়া উচিত। যুগের সাথে সাথে নিত্য নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটতে থাকলে আর তার সরাসরি সমাধান কুরআন-হাদীসে পাওয়া না গেলে তখন ফকীহগণ ইজতিহাদের মাধ্যমে সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করতেন এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে ফিকহ সংকলন অপরিহার্য হয়ে দাড়ায়।
এরকম আরও বহু কারণ দেখা দেয় যেগুলি ফিকহ সংকলনকে অপরিহার্য করে তোলে। ফিকহ চর্চা রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ থেকে শুরু হলেও এক পর্যায়ে এমন একটা যুগের আবির্ভাব ঘটে যখন থেকে পরিপূরণরূপে ফিকহ সংকলন শুরু হয়ে ইসলামী জ্ঞানের ভুবনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়; যা ইসলামকে সকল যুগের জন্য পুরোপুরি যুগোপযোগী করে তোলে।