বর্তমান সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রধান ১০টি কারণ

বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ কী ? অন্যান্য মানবিক সম্পর্কের মত বৈবাহিক সম্পর্কও এমন একটি সম্পর্ক, যা শতভাগ নিখুঁত হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি ভালোবাসাপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এটি আশা করা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সফল ও গভীর বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় অঙ্গীকার এবং পরস্পরের প্রত্যাশাকে প্রতিনিয়ত নিরীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। ব্যাপারটি মুখে বলা যতটা সহজ, বাস্তবে এর প্রতিফলন ততটাই কঠিন।
এই নিবন্ধের আলোচিত বিষয় হচ্ছে, বিবাহ-বিচ্ছেদের পেছনে মূলত প্রধান প্রধান কি কি কারণ রয়েছে। অবশ্য বিভিন্ন জটিল সমস্যা তথা নৈতিকতার পতন ও মাদকাসক্তির মত সমস্যাগুলোও বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য দায়ী, কিন্তু এখানে এমন কিছু নগন্য সমস্যাকে বিবাহ বিচ্ছেদের শীর্ষ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হবে, যা পাঠককে আশ্চর্যন্বিত করবে। বিবাহ বিচ্ছেদের দশটি প্রধান কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হল-
১) পরিবর্তনের চেষ্টা ও বিবাহ বিচ্ছেদের সূচনা
অধিকাংশ দম্পতি একটি বড় সমস্যার মুখোমুখি সম্মুখীন হন। আর তা হল, একজন অপরজনের বিভিন্ন বিষয় অপছন্দ করেন। এই অপছন্দ থেকে সে তার সঙ্গীকে এমন অবস্থায় পরিবর্তন করতে চায়, যা সবসময় সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। পারস্পরিক এই পীড়াপীড়ির কারণে একজন অপরজনের প্রতি বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে।
আপনি চাইলেই আপনার সঙ্গীকে রাতারাতি পরিবর্তন করে আপনার বহুল কাঙ্ক্ষিত নতুন মানুষে রুপান্তরিত করতে পারবেন না। এরচেয়ে বরং আপনার সঙ্গীর ছোট ছোট বিভিন্ন ভুলকে নিজের পছন্দমত ধীরে ধীরে সহমর্মিতার সাথে পরিবর্তনের চেষ্টা করুন।
২) আলাপচারিতা বনাম যোগাযোগ
বর্তমানে বৈবাহিক সম্পর্ককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা আরেকটি বিষয় হচ্ছে দম্পতিদের এই ভুল ধারনা যে, পরস্পরের সাথে সাধারণ আলাপচারিতাই হল যোগাযোগ। এর ফলে তারা যখনই পরস্পরে কোনো আলোচনা করে, তখনই মনে করে তাদের মধ্যে যথার্থ যোগাযোগ রক্ষা হচ্ছে।
কিন্তু এভাবে কথার আদান-প্রদানের মাধ্যমে দম্পতিদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয় না। অভিযোগ বা সমালোচনার পরিবর্তে ইতিবাচকতার সাথে আপনার অনুভূতিকে প্রকাশের পদ্ধতি রপ্ত করুন। আপনার বৈবাহিক সম্পর্কের দৃঢ়তাকে তা বৃদ্ধি করবে।
যথার্থ যোগাযোগ মানে শুধু নিজের মনোভাবকে সঙ্গীর কাছে প্রকাশ করা নয়; বরং এর অর্থ হল নিজের সঙ্গীর মনোভাব সম্পর্কেও জ্ঞাত হওয়া এবং তার অনুধাবনকে অনুভব করতে পারা। যদি আমরা কথা বলার সাথে সাথে কথা শোনারও অভ্যাস করতে পারি, তবে আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কগুলো অনেকাংশেই ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
৩) বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ সময় ব্যবস্থাপনা
জীবনযাত্রা মানেই অনেক চাপের সমন্বয়। এতসব চাপ সামাল দিতে গিয়ে অনেক দম্পতিই হয়ত পরস্পরকে পরিপূর্ণ সময় দিতে ব্যর্থ হয়। প্রত্যহ অল্প সময় হলেও নিজেদের মধ্যে একান্তে কিছু সময় কাটানো প্রয়োজন। বৈবাহিক সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে এর গুরুত্বই সর্বাধিক।
নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ককে প্রতিদিন মূল্যয়নের জন্য সকল দম্পতিরই নির্দিষ্ট কিছু মুহুর্ত একান্তে কাটানো প্রয়োজন। একান্তে সময় কাটানোর মাধ্যমে সম্পর্কের মধ্যে দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪) ঘনিষ্ঠতা
ঘনিষ্ঠতার অভাবজনিত কারনেই মূলত মুসলিমদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ বেশি ঘটে। সহবাস বা যৌনমিলন ঘনিষ্ঠতার একটি ছোট্ট অংশ মাত্র। কিন্তু বেশিরভাগ দম্পতি এটাকেই মূল ঘনিষ্টতা মনে করে। আধ্যাত্মিক, মানসিক, শারীরিক, আবেগগত ইত্যাদি সকল দিক থেকে পরস্পরের মধ্যে সংযোগ থাকাই মূলত দম্পতিদের মধ্যে পারস্পারিক ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করে। বৈবাহিক জীবনে ঘনিষ্ঠতা অর্জন কোনো লক্ষ্য নয়, বরং এটি দম্পতিদের একত্রে জীবনের দীর্ঘসময় চলার জন্য একটি আবশ্যিক উপাদান।
৫) পরস্পরের প্রতি লক্ষ্য রাখা
সন্তান হওয়ার পর মধ্যে প্রায়শই দেখা যায়, পরস্পরের প্রতি মনোযোগ ও দেখভাল করার প্রবণতার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। ফলে অনেক সময় হয়ত অজান্তেই নিজেদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। সন্তান জন্মের পরও সন্তানের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক মনোযোগ প্রদান বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৬) টাকা, টাকা, টাকা
জীবনে চলার জন্য অর্থ-সম্পদ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য এই অর্থই একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম পরিবারগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। অল্পরুজির পুরুষ ও নারীর সংসার বরং অধিকসময় টিকে থাকে; কিন্তু সংসারে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই আয়-রোজগার করেন, তখন তাদের মধ্যে এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় যে, কে কার চেয়ে বেশি আয় করবে। এই প্রতিযোগিতা থেকেই শুরু হয় পারস্পারিক রেষারেষি। যার শেষ পরিণতি বিবাহ-বিচ্ছেদের মাধ্যমে ঘটে।
৭) বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ ক্ষমাহীনতা
ভুলের জন্য না জানি মর্যাদা কমে যায় এই আশংকায় সঙ্গীর কাছে ক্ষমা না চাওয়া এবং ছোট ছোট অপরাধেও সঙ্গীকে ক্ষমা করতে না পারার দরুণ দাম্পত্য সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পরে। আধুনিক এই সময়ে ক্ষমাহীনতার এই বদঅভ্যাস বিবাহ বিচ্ছেদের একটি অন্যতম প্রধান কারণ।
৮) প্রশংসার অভাব
যখন পরস্পরের কোনো কাজে বা অর্জনে প্রশংসা কমে যায়, তখন পরস্পরের মধ্যে সংঘাত বৃদ্ধি পায়। প্রশংসার অভাব বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। কিন্তু যখন দু’জন মানুষ তাদের পারস্পারিক কাজের পুরোপুরি মূল্যয়ন করে এবং উত্তম কাজের জন্য সঙ্গীর প্রশংসা করে, তখন তাদের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা খুবই কমে যায় এবং তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায়।
৯) আবেগগত সম্পর্ক
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রসরতার ফলে ভার্চুয়াল জগতে বিভিন্ন ভার্চুয়াল সম্পর্কে মানুষ জড়িয়ে পড়ছে। এসকল সম্পর্কে অনেকসময় মানুষ তার সঙ্গীর চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। এর ফলে পারস্পারিক বৈবাহিক সম্পর্ক বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
১০) ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে পারস্পারিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ফলেও বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। একজন অপরজনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চাওয়া এবং সঙ্গীকে নিজের মত করে চালাতে চাওয়ার ফলে পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়।
যদি পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্কের তুলনায় নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করার গুরুত্ব বেশি হয়, তবে সে সম্পর্ক বেশিদি স্থায়ী হয় না। আবার কারও মত যদিও প্রতিষ্ঠিতও হয়, তবে সেখানে আর ভালোবাসা থাকে না।
নিজেদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ককে গভীর ও দৃঢ় সম্পর্কে পরিণত করতে আমরা এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সতর্ক হতে পারি। এর মাধ্যমে আমরা দুনিয়াবি জীবনে নিজেদের সঙ্গীর সাথে সুন্দর সময় কাটানোর পাশাপাশি আখিরাতের জীবনেও সাফল্য অর্জন করতে পারি।