বলকান অঞ্চলঃ অটোমানদের সংস্কৃতি এখনও বহাল যেখানে

প্রাচুর্য্যে ভরা ইউরোপ মহাদেশ সত্যিই একটি মনোরম ভ্রমণক্ষেত্র। শতাব্দির পর শতাব্দি জুড়ে এখানে ঘটেছে হাজার হাজার ঐতিহাসিক ঘটনা যা আজও মানুষকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। এই ইউরোপেরই দক্ষিণ–পূর্বে অবস্থিত বলকান অঞ্চল, বেশ কয়েকটি দেশ সমষ্টি এই অঞ্চলটির কথা আজ আমরা জানব।
বলকান অঞ্চলের অবস্থানঃ
বলকান অঞ্চল বলতে বোঝানো হয় আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হারজেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রীস, কোসোভো, ম্যাসিডোনিয়া, মন্টেনিগ্রো, রোমানিয়া, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া এবং তুরস্কের ইউরোপীয় অংশ। ঐতিহাসিক এই দেশ গুলির সমষ্টিতে গড়ে ওঠা বলকান অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক পার্থক্য রয়েছে। তবে বেশ কিছু জায়গায় এরা একই সুতোয় বাঁধা।
এটি এক তুর্কি শব্দ যার অর্থ ‘পাহাড়‘। আশেপাশের ভূমিরূপ পাহাড়ি ও দুর্গম হওয়ায় নামকরণের কারণ স্পষ্ট।
বলকান আদিবাসীদের ইতিহাস তিন হাজার বছরেরও পুরোনো। ইতিহাসের পালাবদলে একে একে রোমান, গ্রীক, স্লাভ ও হাঙ্গেরীয় রাজত্বের পর অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে আসে বলকান।
এই বিশাল অঞ্চলে অটোমানদের পাঁচশ বছর রাজত্ব চলাকালীন ঘটেছে বহু পরিবর্তন যা পরবর্তি ইতিহাসকে আকার দিয়েছে।
বলকান অঞ্চলের ইতিহাসঃ
এই অঞ্চলের ইতিহাসে বিভাজনের চিত্র স্পষ্ট। একদা রোমান সাম্রাজ্যের অংশ এই অঞ্চল খ্রিস্ট ধর্মের আগমনের সময় বলকানদের প্রধান দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল, একদল হয়েছিল রোমান ক্যাথলিক অন্যদল হল অর্থোডক্স বাইজেন্টাইন।
এর প্রায় হাজার বছর পর অটোমান শাসনের সময় বলকানরা বিভক্ত হল খ্রীস্টান ও মুসলমানে।
ধর্ম ও রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়ের ঊর্ধ্বে গেলে দেখা যায় বলকান জাতি পৃথিবীর অন্যতম উন্নত জাতিগুলির একটি। একেবারে শুরু থেকেই শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং জীবনধারণের মান অনেক উন্নত ছিল বলকানদের। এর উদাহরণ তাদের খাদ্যাভাসেও পাওয়া যায়।
হাজার পার্থক্য দিয়ে বলকানদের আলাদা করলেও, শেষে তারা একটি বিশাল জনগোষ্ঠী হিসাবে নিজেদের বারবার প্রমাণ করে দেয়।
বলকানদের সংস্কৃতিঃ
বলকান সংস্কৃতি শিল্প ও সৃজনশীলতাকে চিরকাল গুরুত্ব দিয়েছে। তিন হাজার বছরের যুদ্ধ, রক্তারক্তির ইতিহাসে তারা আবেগ অনুভূতির জায়গাগুলিকে ছোটো করে দেখেনি। প্রাচুর্য্য ও বৈচিত্রে ভরা বলকান শিল্পকলা দেখলে বোঝা যায় ওই জাতির দীর্ঘ ইতিহাসের কথা, ফুটে ওঠে একটা জাতির বির্বতন।
কঠিন সময়ের মধ্যেও কীভাবে নিজের স্বাতন্ত্র্যকে ধরে রাখতে হয় তা বলকানরা জানে।
যদি খাবার দিয়ে শুরু করি তাহলে বলতে হয় বলকানদের খাদ্যাভাসের কথা। ঐতিহ্যবাহী বলকান খাবারগুলি শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে চলে আসছে সমান জনপ্রিয়তার সাথে।
আজ বিশ্বায়নের যুগে ফাস্ট ফুড সমস্ত বাড়িতে থাবা বসালেও বলকানরা তাদের ঐতিহ্যকে ভুলে যায়নি।
এছাড়াও খাবার পরিবেশনের জন্য বিভিন্ন সেরামিকের পাত্র যেমন প্লেট, গ্লাস, বোল সবই বলকানদের হাতে তৈরি। আগেই বলেছি শিল্পকলাতেও বলকানরা কম যায় না, ছেলে–মেয়ে সবাই কাঠ, পাথর বা ধাতু দিয়ে হাতের কাজের বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে পটু।
এছাড়া বিভিন্ন ধরণের গালিচা তৈরিতেও বলকান মেয়েদের জুড়ি নেই।
অঞ্চলটির মানুষজনঃ
বলকান অঞ্চলের মানুষদের অতিথিবৎসল বলে সুনাম আছে। বহু ঐতিহাসিক ঘটনায় বলকানদের বন্ধুত্বের নমুনা পাওয়া যায়। এখানকার মানুষরা পর্যটকদেরও উষ্ণ অভিবাদন জানান এবং খুব সহজে আপন করে নেন। বলকানদের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নাতীত। আলবেনীয়দের মধ্যে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, কাউকে যদি ‘বেসা‘ বলে অভিবাদন জানায় একজন আলবেনীয় ব্যক্তি তাকে রক্ষা করার জন্য বা তার সাহায্যার্থে, সেই ব্যক্তি সবকিছু করতে পারে। এটাকে অটুট বন্ধন বা দায়িত্বের শপথ বলা যেতে পারে।
এই আলবেনীয়দের অতিথিবৎসলতার উদাহরণ পাওয়া যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেসময় প্রায় ২০০০ ইহুদি পরিবার আশ্রয় পেয়েছিল আলবেনীয়দের কাছে।
এই ঐতিহাসিক, শৈল্পিক এবং অতিথিবৎসল জাতিকে নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায়। পৃথিবীতে এরকম নমুনা সত্যিই বিরল।