বল্কান অঞ্চলের দেশগুলিতে হত্যালীলা চললেও পালিয়ে যাননি মুসলিমরা

বল্কান উপদ্বীপ অঞ্চল হল ইউরোপ এবং এশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা, যার সমুদ্র সীমান্তের অপর প্রান্তেই রয়েছে উত্তর আফ্রিকা। এই এলাকায় নিম্নলিখিত দেশগুলি রয়েছে; তুরস্ক, গ্রীস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়া, কসোভো, মন্টেনেগ্রো, সার্বিয়া, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া এবং স্লোভেনিয়া। এর শেষ সাতটি দেশ হল ফেডেরাল রিপা্ব্লিক অফ যুগোশ্লাভিয়ার সদস্য, যা ১৯৯০-তে বিভক্ত হয়েছিল।
নয়ের দশকের বল্কান অঞ্চল
কমিউনিজমের পতন এবং যুগোশ্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার সাথে সাথে, বল্কান মুসলিমরা একটি নতুন সমস্যার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। আমরা জানি যে সেই সময় অন্তত বসনিয়ায় অন্তত ২ লক্ষ মুসলিম খুন হয়েছিলেন এবং কসোভোতে সেই সংখ্যাটা ছিল ১০ হাজারের কাছাকাছি। নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, ১৯৯৫ সালে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে স্রেবেনিস্তাতে ৬০০০ মুসলিমের হত্যার ঘটনাতেই সেই সময় দমন এবং হত্যালীলার ছবিটি পরিষ্কার হয়ে যায়, যা সেই সময় এই এলাকার মুসলিমরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
এই হত্যালীলা চলা সত্ত্বেও, যা আধুনিক যুগের এমন এক সময় ঘটেছিল যখন সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রতিটি দেশ অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিল, মুসলিমরা বল্কান অঞ্চল ছেড়ে চলে যাননি। এখনও ফেডেরাল বসনিয়া হার্জিগোভিনাতে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে তারা ক্রোয়েশিয়া এবং স্লোভেনিয়াতে সংখ্যালঘু। সার্বিয়া (সানকাক এবং প্রেজোভা ভ্যালি)এবং মন্টেনেগ্রোতে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়ার পাশাপাশি খুবই দুর্বল পরিস্থিতিতে রয়েছে। তবে কসোভো এবং মেসিডোনিয়াতে মুসলিমরাই হল সংখ্যাগরিষ্ঠ। শুধু তা-ই নয়, এই দেশগুলির জনগণের অর্ধেকই হলেন মুসলমান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আলবেনিয়াতে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দেখালেও পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। বুলগেরিয়া এবং গ্রীসে মুসলিমরা এখনও সংখ্যালঘু।
এই পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৭ মিলিয়ন মুসলিম বল্কান অঞ্চলে বসবাস করেন (তুরস্কের মাটিকে এই হিসেব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, বল্কান অঞ্চলের সামগ্রিক জনসংখ্যা হল ৫০ মিলিয়ন)। এই তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, খ্রিস্টান ধর্মের পরেই বল্কান অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হল ইসলাম।
বল্কান অঞ্চলের স্থিতাবস্থা এবং বাস্তব সমস্যা
যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পরিবর্তনশীল সময়ে, বল্কান অঞ্চল পুনর্গঠিত হয়েছে, অন্তত রাজনৈতিক ভাবে। এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ, যেমন রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, স্লোভেনিয়া এবং গ্রীস, বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-এর সদস্য। ২০১৩ সালে ক্রোয়েশিয়াও এর সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। তবে বসনিয়া হার্জেগোভিনার রাজনৈতিক অস্থিরতা, কসোভোর রাজনৈতিক পরিচিতি সংক্রান্ত সমস্যা এবং মেসিডোনার নাম নিয়ে গ্রীসের সাথে সংঘাতের জেরে, এই দেশগুলির ইইউ-এর সদস্যপদ লাভ করা কিছুটা জটিল। তবে সার্বিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনা এবং কসোভা বাদ দিলে, বল্কান অঞ্চলের বাকি প্রতিটি দেশই ন্যাটো-র সদস্য।
এই ধরনের উঁচু মাপের রাজনৈতিক সাফল্য হাসিল করা সত্ত্বেও, বল্কানদের সামাজিক পরিস্থিতি এখনও খুব একটা স্পষ্ট নয়। যে আর্থিক সঙ্কট গ্রীসে প্রভাব ফেলেছে এবং গোটা ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছে, তা সহজেই এই অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিতে পারে। বিশেষ করে আলবেনিয়া, যেখানে যথেষ্ট পরিমাণে ইতালির এবং গ্রীসের বিনিয়োগ রয়েছে, ভীষণ রকম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়াও প্রায় ৫০,০০০,০০ আলবেনীয় পরিযায়ী ইতালি এবং গ্রীসে কর্মরত রয়েছেন।
বল্কান অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ সুসম্পর্ক
এই দেশগুলি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করলেও, বল্কান দেশগুলির উন্নয়নের পথে এখনও যথেষ্ট বাধা রয়েছে। এই দেশগুলি এখনও যুদ্ধের ক্ষত পুরোপুরি সারিয়ে উঠতে পারেনি। তার উপরে এই দেশগুলির পারস্পরিক সুসম্পর্কের অভাব এই অঞ্চলের পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ। আরও একটি কারণ হল, এই অঞ্চলের এক একটি দেশের সমস্যা এক এক রকম। ফলে সেগুলি মেটানোর জন্য ভিন্ন কিন্তু উপযুক্ত পন্থা প্রয়োগ করতে হবে। এই অঞ্চলের বহু দেশ ইইউ এবং অধিকাংশ দেশ ন্যাটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব রাজনীতিতে এই এলাকার অবদান খুবই কম। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হলে, সবার প্রথমে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
সবার প্রথমে বলা যায় যে, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধ মিটিয়ে নিলেই, এই অঞ্চলের মুসলিমরা বিশ্বের যে কোনও উন্নত রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাল্লা দিতে পারবেন। বিশেষ করে যে সমস্ত দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, সেই দেশগুলির মুসলিম নাগরিকরা যদি প্রতিবেশী দেশের মুসলিমদের পাশে পান, তাহলে তাঁদের উন্নয়ন অনেক দ্রুত হতে পারে। এছাড়াও, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই দেশগুলির সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং মিডিয়া সংক্রান্ত উদ্যোগকে অনুপ্রেরণা ও তহবিল সরবরাহ করা হচ্ছে, যা একদমই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। এই ধরনের উদ্যোগ ও বিনিয়োগের পরিমাণ যত বাড়বে, তত এই দেশগুলির অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে। এবং বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে যে দেশ যত বেশি ধনী, সেই দেশের দাপট তত বেশি। এই এলাকায় রাজনৈতিক স্থিরতা প্রতিষ্ঠিত হলে, এই দেশগুলি যে কোনও উন্নত দেশের সাথে এক আসনে বসার যোগ্যতা রাখে।