বহু চেষ্টা করেও ইসলামকে দমিয়ে রাখতে পারেনি সোভিয়েত রাশিয়ার কম্যুনিস্ট সরকার

রুশ বিপ্লব মধ্য এশিয়ায় ইসলামের চেহারা বদলে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরে, ফের ইসলামের উত্থান হয়েছিল।
১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে ভ্লাদিমির লেনিন এবং জোসেফ স্ট্যালিন একটি ঘোষণাপত্র সই করেছিলেন যার বয়ান ছিল এই রূপ, “রাশিয়ার সমস্ত মুসলমান, ভোলগা এবং ক্রিমিয়া, কিরগিজ, এবং সাইবেরিয়া ও তুর্কস্তানের কিছু অংশ, তুর্কি এবং ট্রান্স-ককেশিয়ার তাতার, চেচেন এবং ককেশাসের পার্বত্য এলাকার জনগণ, এবং সেই সমস্ত নাগরিক যাদের মসজিদ ও নামাজের ঘরগুলি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও পরম্পরা জার ও রাশিয়ার অত্যাচারীরা অহঙ্কারভরে চূর্ণ করার চেষ্টা করেছে, (ঘোষণা করা হচ্ছে) আপনাদের বিশ্বাস, আপনাদের জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি চিরকালের জন্য মুক্ত ও অদম্য। সর্বদা মনে রাখবেন, আপনাদের অধিকার, রাশিয়ার অন্য বাসিন্দাদের মতোই, বিপ্লবের শক্তিশালী সুরক্ষার অধীনে সম্পূর্ণ নিরাপদ।”
শরিয়াহ আইন চালু ছিল একদা
রুশ বিপ্লবের সময়, জাদিদ নামে পরিচিত বহু মুসলিম সংস্কারক, সোভিয়েত ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। তার ফলস্বরূপ, মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ও বলশেভিকদের মধ্যে ৭০% ছিল মুসলমান। এই সময়, সমগ্র মধ্য এশিয়ায় শুক্রবারকে আইনী ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং ১৯২১ সালের মধ্যে সোভিয়েত আইন ব্যবস্থার পাশাপাশি শরিয়ত আইনও চালু করা হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে, জারের আমলে নিপীড়িতদের বিশ্বাস অর্জন করা বলশেভিকদের পক্ষে জরুরি ছিল। কিন্তু মুসলিমদের বিশ্বাস ও সমর্থন অর্জন করার পরে, লেনিন ধর্ম নির্মূল করার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন।
মার্কসবাদ কঠোর ভাবে বাস্তবায়িত করার জন্য ঘোষণা করা হয়, এই রাষ্ট্র ধর্মবিরোধী নয় বরং ধর্মহীন হবে। এই সময় মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আগ্রাসন শুরু হয়। বলশেভিকরা বিশ্বাস করতেন যে, নারীদের তথাকথিত মুক্তি সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করবে। ইসলামকে দুর্বল করার পদক্ষেপ হিসেবে যে পদক্ষেপগুলি রাশিয়ার কম্যুনিস্ট সরকার গ্রহণ করেছিল, তার মধ্যে একটি ছিল বোরখা নিষিদ্ধ করা।
মহিলাদের হিজাব নিষিদ্ধ
হুজুম (অতর্কিত হামলা) অভিযান উজবেকিস্তান (এবং আজেরবাইজান) শুরু হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মধ্য এশিয়ার মহিলাদের উৎসাহিত করা, যাতে তাঁরা পর্দাসীন থাকতে অস্বীকার করেন। ১৯২৭ সালে আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসে (৮ মার্চ), দু’বছর ধরে ব্যর্থ প্রচারের পরে, হুজুম একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। বিভিন্ন জনসভায় মহিলাদের পর্দা ত্যাগ করার আহ্বান জানানো শুরু হয়। ছোট ছোট দলে তাদের মঞ্চে আসতে বলা হত, এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মুখ থেকে আবরণ সরানোর আবেদন জানানো হত।
হুজুম সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। বহু মহিলা পর্দাসীন থাকতে অস্বীকার করলেও অধিকাংশ মহিলাই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেন, হুজুমের উদ্দেশ্য শুধুই নারীমুক্তির চেতনা জাগ্রত করা ছিল না, বরং মুসলিম সংস্কৃতিকে আঘাত করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়া আরবি ভাষা-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৩০ সালে আরবির পরিবর্তে ল্যাটিন অক্ষর বাধ্যতামূলক করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করে মুসলমানরা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইসলামের উপরে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল, কারণ এই যুদ্ধের জন্য সোভিয়েত নাগরিকের বিপুল সমর্থন প্রয়োজন ছিল। গ্রেট প্যাট্রিয়টিক ওয়ার নাম দিয়ে সরকার নাগরিকদের আহ্বান জানিয়েছিল এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। ১৯৪৩ সালে স্পিরিচুয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ দ্য মুসলিমস অফ সেন্ট্রাল এশিয়া অ্যান্ড কাজাখস্তান (SADUM) প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সরকারের সতর্ক নজরদারির মধ্যে উলেমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও বিভিন্ন ধর্মীয় বই ছাপা হতে থাকে।
ধর্মের উপরে বিধিনিষেধ শিথিল হতেই মসজিদ খুলতে শুরু করে, এবং ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় বৈধ মসজিদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১৫। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে সোভিয়েত সরকার মুসলিমদের দুই ভাগে বিভক্ত করে, সমাজতন্ত্র-বান্ধব ও সমাজতন্ত্র-বিরোধী। সমাজতন্ত্রের বন্ধু বলতে সেই মুসলিমদের বোঝানো হত, যাঁরা রাষ্ট্রীয় অনুশাসন মেনে চলতে সম্মত হতেন। এই মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করতেন রাষ্ট্র-নিযুক্ত উলেমারা। অপর দিকে, সমাজতন্ত্র-বিরোধী মুসলিম অর্থে তাঁদের বোঝানো হত, যাঁরা নিজেদের ধর্মকে রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন।
আশির দশকে ইসলাম পাঁচটি মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রের মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। যা সম্ভব হয়েছিল পেরেস্ত্রোইকা এবং গ্লাসনোস্ট-এর মতো সমাজ সংস্কার নীতির জন্য। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপরে দলীয় নিয়ন্ত্রণে অসন্তুষ্ট মুসলমানরা ধর্মীয় বিষয়ে আরও বেশি স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকে। এর জেরে ফের আরবি ভাষায় পবিত্র কুরআন ছাপা হতে শুরু করে। ধর্মীয় শিক্ষাও পুনরায় শুরু হয়।
১৯৯১ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ১৯৯১ তে, সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে গেলে মধ্য এশিয়ার পাঁচটি প্রজাতন্ত্র নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা হল, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তান। এই পাঁচটি প্রজাতন্ত্রই মুসলিম বিশ্বে যোগদান করেছিল।