বাংলার ভাগ্যাকাশে চক্রান্ত ঘনীভূত হওয়ার দিন

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা বা মির্জা মুহাম্মাদ সিরাজ-উদ-দৌলা ( জন্ম: ১৭৩২ – মৃত্যু: ১৭৫৭) বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব। ২৩শে জুন পলাশির যুদ্ধে পলাশির প্রান্তর রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছিল, পরাজিত হয়েছিলেন বাংলার শেষ নবাব সিরাজ। কিন্তু এই দিনটাকে কি মনে রাখি আমরা?
নানা আলিবর্দী খানের হাত ধরে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল। বাংলা বিহার উড়িষ্যার তিনি নবাব হন মাত্র ২৩ বছর বয়সে। ২ জুলাই ১৭৫৭ পর্যন্ত ১৪ মাস ১৪ দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর হত্যার দিন তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। ইংরেজ কূটনৈতিক এবং পলাশী যুদ্ধে উপস্থিত লুক স্ক্রাপটন নবাব সিরাজের মৃত্যু ৪ তারিখে বলে উল্লেখ করে গেছেন।
২৬৩ বছর আগে পলাশীর প্রান্তরে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সিরাজউদ্দৌলার পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজন, তার পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ।
যুদ্ধ না ষড়যন্ত্র
সিরাজের এই হেরে যাওয়া কী সত্যিই হেরে যাওয়া? তিনি তার শেষ বিন্দু অবধি লড়েছিলেন এই বাংলার জন্য অথচ বাংলা তাকে মনে রাখে না,পলাশির যুদ্ধ কি আদৌ যুদ্ধ ছিল নাকি ষড়যন্ত্র?
একটা রক্তমাংসের মানুষের সাথে অপর একটি রক্তমাংসের মানুষের সম্পর্কটা তৈরী হয় একটা খুঁটির ওপর ভিত্তি করে, আর এই খুঁটিটা হল বিশ্বাসের।যখন এই খুঁটিটা নড়ে যায় তখন শুরু হয় ভাঙন। বিশ্বাসঘাতকের থেকে বড়ো শত্রু কখনো হতে পারে না, এক্ষেত্রেও হয়নি।
নিজের পরিবার বা নিজের রাজ্যের লোকেরা যদি বিশ্বাসঘাতক হয়, তখন নবাবের কিছুই করার থাকে না। তবু সিরাজ লড়েছিলেন।
মুর্শিদাবাদ ও নবাবদের অবদান
আলিবর্দী খাঁ নিজের শেষদিন অবধি বাংলার জন্য যা করেছেন, তা অনস্বীকার্য। ১৭৪২ থেকে ১৭৫২ পর্যন্ত বারবার মারাঠাদের আক্রমণে বাংলা কেঁপে উঠেছে, কৃষকদের ক্ষতি, ফসল নষ্ট, রাজস্ব নষ্ট, বহু মানুষ নিহত হয়, কত নারী ধর্ষিত হয়। কেউই মারাঠাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি কারন তাদের আক্রমণ দস্যুর মতো গেরিলা কায়দায়, সরাসরি যুদ্ধে নামেনা বলে কেউই এদের পরাজিত করতে পারেন না। আলিবর্দী খাঁর এই বিপর্যয়ে প্রচুর সৈন্য মারা যায় ও খরচ বাড়তে থাকে। তখন তিনি ছলনার আশ্রয় নেন।
মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত সহ ২২জন সেনাপতি কে সন্ধির নামে ডেকে এনে নজরানার লোভ দেখিয়ে আমন্ত্রণ করে হত্যা করেন। কিন্তু মারাঠা দমন হলেও ঘটে বিপত্তি। প্রচুর খরচ বেড়ে যায়, এদিকে কোষাগারের অবস্থাও খারাপ হয়ে পড়ে। তখন আলিবর্দী বাধ্য হন রাজবল্লভ, উমিচাঁদ দের কাছে ঋণ গ্রহণ করতে। এছাড়া জগৎ শেঠের কাছেও ঋণ হয়ে যায়। আর যখনই বনিকেরা ক্ষমতাবান হয়েছে তখনই সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এখানেও তার বিকল্প ঘটেনি। এই সমস্যায় আবার আর একটা সমস্যা এসে পড়ে। দিল্লির সম্রাটের বন্ধু পূর্ণিয়ার নবাবের বাংলা আক্রমণ ঠেকিয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলা ও তাকে হত্যা করে সিরাজ বাংলা কে বাঁচিয়েছিল।
আলিবর্দী খান দরবারে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা দেন, আমার পরে সিরাজউদ্দৌলাই বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করবে। ইতিহাসে এই ঘটনাকে সিরাজউদ্দৌলার যুবরাজ হিসেবে অভিষেক বলে অবিহিত করা হয়েছে।
সিরাজের বিরোধিতা
সিরাজকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করার ঘটনা তার আত্মীয়বর্গের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। অনেকেই তার বিরোধিতা শুরু করেন। সিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসেই প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। মীরজাফরকে সেনাবাহিনীর প্রধান বখশির পদ থেকে সরিয়ে মীর মর্দ্দানকে সেখানে নিয়োগ দেন। এছাড়া মোহন লালকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করা হয়।
এরপর সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের কলকাতায় অবস্থিত কাশিমবাজার কুঠির ব্যাপারে মনযোগী হন। কারণ সিরাজউদ্দৌলা তাদের এদেশে কেবল বণিক ছাড়া আর কিছু ভাবেননি। এ কারণে ১৭৫৬ সালের ২৯ মে কাশিম বাজার কুঠি অবরোধ করা হয়। ফলে ইংরেজরা নবাবের হাতে যুদ্ধাস্ত্র তুলে দিয়ে মিথ্যা মুচলিকার মাধ্যমে এ যাত্রায় মুক্তি পায়। কলকাতার নাম বদল করে নবাব আলীবর্দী খানের নামানুসারে ‘আলী নগর’ রাখা হয়।
কিন্তু নিজের আত্মীয় ঘসেটি বেগম সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ছক কষতে শুরু করে। সিরাজ জানতে পেরে তাকে নজরবন্দি করলেও লাভ হয়নি। কারণ তার বিশ্বস্ত মন্ত্রী মীরজাফর, জগৎ শেঠ, ঘসেটির দলে নাম লিখিয়ে ছিল। সালটা ছিল ১৭৫৭, কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করল না, নবাব তখনই বুঝে গেছিলেন তাঁকে পরাজিত করার ষড়যন্ত্রে সেনাপতিরাও শামিল, পলাশীর যুদ্ধে নামক জরুরি অবস্থার শিকার হন নবাব ও তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমর্দান ও মোহনলাল। বিশ্বাসঘাতকের মধ্যেও যেমন হিন্দু-মুসলিম ছিল, তেমনি আত্মত্যাগী শহীদ হয়েছেন উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ।
সিরাজের পতনে সর্বস্বান্ত বাংলা
পরাজিত নবাবকে বন্দী করে তাঁরই রাজধানীতে এনে রাখা হয়, এইসময় স্বাধীন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদের কিছু এলিট তাঁকে উপহাস করতে ছাড়েনা, তাঁরই রাজধানী অথচ তাঁর লাশকেই অপমান করা হয়। মুর্শিদাবাদের এলিট ও সুশীল সমাজ বুঝতে পারেনি যে সিরাজের প্রতি হিংসা করতে গিয়ে নিজেরাই আসলে ক্ষমতা হারাল। বাংলার পরাজয়ের পর ভারতে ২০০ বছর ইংরেজ ও তাদের দালাল বুদ্ধিজীবীরা তাঁর চরিত্রে কালিমা ছিটায়। কলকাতার সেরা বুদ্ধিজীবীরা সিরাজকে ভিলেন বানিয়ে ইংরেজকে পরিত্রাতা হিসেবে বন্দনা করেন, শুধু তা না সিরাজের রাজকোষের টাকা চুরি করে ইংরেজের দুর্গে আশ্রয় নেওয়া নবকৃষ্ণ দেব সিরাজের পতনের পরে কলকাতার বিখ্যাত শোভাবাজার রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে ইংরেজের উন্নয়নের সুফল জমিদাররা পেয়েছিলেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়েছিল বাংলা।
তাই গর্ব করেই বলা যায় বাংলার শেষ নবাব হিসেবে সিরাজউদ্দৌলা কোনো অংশে কম ছিল না, তিনিই বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম একজন স্বাধীন সুলতান নিজেকে ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।