মানবাধিকার হিসেবে বিশ্বে বিবেচিত হোক পানি
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৫ নং অনুচ্ছেদে লেখা আছে, “প্রত্যেকেরই নিজের এবং তার পরিবারের সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জীবনধারণের অধিকার রয়েছে, যার মধ্যে খাবার, পোশাক, বাসস্থান, চিকিত্সা সেবা এবং প্রয়োজনীয় সামাজিক পরিসেবাগুলি অন্তর্ভুক্ত” । এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মানুষের অধিকার হিসাবে পানির প্রয়োজনীয়তা কিন্তু এখানে অনুপস্থিত।
এ অংশে আমরা দেখব কিভাবে মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো মানবাধিকার শ্রেণিভুক্ত না হয়ে শুধুমাত্র প্রয়োজনের সীমার মধ্যেই থেকে যায়।
যেমন কোভিড -১৯ প্রতিরোধের জন্য যুক্তরাজ্যে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর এবং পিপিই ছিল না, কিন্তু যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য সরকার মানুষকে হত্যা করার জন্য কয়েক হাজার আগ্নেয়াস্ত্র জমা করে রেখেছে, কিন্তু মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক পোশাক তারা সরবরাহ করতে পারেনি।
মানবাধিকার নিয়ে কী বক্তব্য সারা বিশ্বের?
armscontrol.org এর দেওয়া তথ্য মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য ২০১৯ সালে ৮.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এই অর্থ দ্বারা তারা ১০০,০০০ আই.সি.ইউ বেড, ৩,০০০ ভেন্টিলেটর, ৫০,০০০ নার্স এবং ৪০,০০০ ডাক্তারকে বেতন দিতে পারত।
যুদ্ধ সরঞ্জাম যদি জীবনরক্ষার্তেই মজুদ রাখা হয় তাহলে এখন কেন জীবনরক্ষার্তে ডাক্তারদের প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক পোশাক সরবরাহ করা হচ্ছে না?
পানি বা স্বাস্থ্যসেবা কেন মানবাধিকার হিসাবে বিবেচিত হয় না?
এটি লক্ষণীয় যে, মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৫ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে পানিকে মানবাধিকার হিসাবে গণ্য করা হয় না। এটিকে কুরআনের সাথে তুলনা করে দেখুন যা মানব অস্তিত্বের শুরু থেকেই চারটি প্রয়োজনীয় বিষয়কে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেঃ খাদ্য, পানি, পোশাক এবং আশ্রয়। কুরআনে বলা হয়েছেঃ
“যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললামঃ তোমরা আদমকে সেজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সবাই সেজদা করল। সে অমান্য করল। অতঃপর আমি বললামঃ হে আদম, এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু, সুতরাং সে যেন তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে না দেয়। তাহলে তোমরা কষ্টে পতিত হবে। তোমাকে এটি দেওয়া হল যে, তুমি এতে ক্ষুধার্ত হবে না এবং বস্ত্রহীণ হবে না। এবং তোমার পিপাসাও হবে না এবং রৌদ্রেও কষ্ট পাবে না। (সুরা ত্ব-হাঃ আয়াত ১১৬-১১৯)
সকলেই অবশ্য বিশ্বাস করেন না যে, পানি একটি মানবাধিকার। নেসলে গ্রুপের প্রাক্তন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিটার ব্র্যাবেক-লেটমেথের একটি তথ্যচিত্রে বলেছিলেন, “পানিকে মানবাধিকার ঘোষণার বিষয়টি দ্বিধামুক্ত। তার মানে মানুষ হিসাবে আপনার পানির অধিকার থাকা উচিত। এটিই একমাত্র সমাধান। কেউ কেউ বলেন যে, পানি একটি খাদ্যদ্রব্য এবং এটিরও মূল্য নির্ধারণ হওয়া উচিত।” (মুইর, ২০১৩)
মানবাধিকার হোক মর্মস্পর্শীঃ
অধিকার এবং প্রয়োজনীয় বিষয়াদির কর্পোরেশন আরও এক মর্মস্পর্শী পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন আমরা দেখি ফুটপাতের স্যান্ডউইচ বিক্রেতা বিজ্ঞাপন জারী করেছে :
“আপনাকে এবং আপনার সন্তানকে রক্ষার জন্য বিনামূল্যে মেডিকেল মাস্ক!
দুটি স্যান্ডউইচ কিনুন এবং একটি মাস্ক বিনামূল্যে পান!”
যখন মানুষের প্রয়োজনকে শোষণ এবং বিদ্রূপ করা হয় তখন এ ধরনের বিজ্ঞাপন স্বাভাবিক হয়ে যায়। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, আমরা চিকিত্সকদের জন্য সুরক্ষামূলক পোশাকের উপরে অস্ত্রের মজুদকে প্রাধান্য দিয়েছি।
আমরা জানি, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলতত্ত্ব হলো বৈষম্য এবং অবিচার দূর করা। যতক্ষণ পর্যন্ত ন্যায়ভাবে অধিকার বন্টিত না হয় এবং কোনো একজন ব্যক্তিও অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলাম এর বৈধতা দেয় না, কারণ এটি সামাজিক ন্যায়বিচার নীতির বিপরীত। এটি কোরআনের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। “আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফর, পাপাচার ও নাফরমানীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী। ”(সূরা হুজরাতঃ আয়াত ৭):
আল্লাহ তা’আলা কোনো সমাজের সফলতাকে তার বাণিজ্য বা বিলাসিতা দ্বারা পরিমাপ করেন না; কিন্তু সকল দেশ প্রায়শই জিডিপিকে তাদের উন্নতির মৌলিক পরিমাপ হিসাবে উল্লেখ করে।
পরিমাপের অন্যান্য মাধ্যমও আছে, যেমন ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’। একটি সফল সমাজ বোঝাতে এটি নিম্নলিখিত বিষয়গুলিক গণ্য করেঃ জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মানসিক সুস্থতা, স্বাস্থ্য, সময়ের ব্যবহার, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সুশাসন, পরিবেশগত বৈচিত্র্য এবং সমাজের প্রাণশক্তি।
রাজনৈতিক নেতাদের উচিত ‘সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন’ প্রস্তাবনা। স্বাস্থ্য, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম মজুরি এবং নিরাপদ অবসর যাপন এইসব খাতে পরিকল্পনা রূপায়ণ। আমরা যদি এটির বাস্তবরূপ পেতে চাই তবে এখনই লড়াই করার যথপোযুক্ত সময়।