ব্রুনাই: দক্ষিণ চীন সাগরে ইসলামের দেশ

গল্পটা আসলে চোদ্দজন ভাইয়ের, যারা নিজেদের জন্য আলাদা একটা দেশ খুঁজতে বেরিয়েছিল। তাদের খুঁজে পাওয়া সেই নিজস্ব দেশ আজ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মানব উন্নয়ন সূচকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে রয়েছে। শুধু তাই নয়, যার নামের মধ্যেই ধ্বনিত হয় শান্তির মন্ত্র, সেই নিগারা ব্রুনাই দারুসসালাম কিন্তু আদতে ৫৭৭০ বর্গকিলোমিটারের এক ছোট্ট দেশ। বোর্নিও দ্বীপপুঞ্জের উত্তর উপকূলীয় অঞ্চলে, দক্ষিণ চীন সাগর ঘেঁষে এর অবস্থান।
ব্রুনাই নামের উৎপত্তি
এই চোদ্দজনের ভাইয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন আওয়াং অলক বেতাটার, যিনি ব্রুনাই-এর প্রথম শাসক। কথিত আছে, দেশটি খুঁজে পাওয়ার পর তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘বারু নাহ’। মালয় ভাষায় যার অর্থ , এইখানেই! সেই ‘বারু নাহ’ থেকেই ব্রুনাই নামের উৎপত্তি।
অনেক ভাষাবিদের মতে, চতুর্দশ শতকে সংস্কৃত শব্দ ‘বরুণ’ থেকে ব্রুনাই নামের উদ্ভব। বরুণ শব্দের অর্থ সমুদ্র। বর্তমানে দেশটির পুরো নাম নিগারা ব্রুনাই দারুসসালাম, যার অর্থ শান্তির দেশ ব্রুনাই। নিগারা শব্দটি মালয়, যার অর্থ দেশ। আর আরবি শব্দ দারুসসালামের অর্থ শান্তিস্থল।
ইসলাম ও ব্রুনাই
ব্রুনাই-এর জাতীয় ধর্ম ইসলাম। বর্তমান জনসংখ্যার ৮২.৭০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম পালন করেন। এদের মধ্যে মূলত মালয় বংশজাত সুন্নিদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এঁরা ইসলামের শফি ঘরানায় বিশ্বাসী। এছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে মালয় ব্রুনাই মুসলমান, মালয় কেদায়ান মুসলমান ( যাঁরা এই অঞ্চলের উপজাতীয় ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন) ও চৈনিক-ইসলাম ধর্মাবলম্বিরাও রয়েছেন।
ইসলামের সূচনা
ব্রুনাই-এ ইসলামদের সূচনা ঠিক কবে হয়েছে সেই বিষয়ে জানতে গেলে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে সেই চোদ্দ ভাইয়ের গল্পে। আনুমানিক হিজরি ৭৬৪ সনে তাঁদের মধ্যে যিনি বড়, সেই আওয়াং অলক বেতাটার নিজেকে শাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন। এরপর, হিজরি ৮২৮ সনে তিনি মালাক্কার সুলতান মহম্মদ শাহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর নতুন নাম হয় মুহাম্মদ শাহ। তখন থেকেই ব্রুনাইতে সুলতানি শাসনের পত্তন হয়। ইসলাম ধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই এ দেশের মানুষদের মধ্যে আরবিয় ও ইসলামী সংস্কৃতির প্রসার শুরু হয়।
আরব ও মক্কা থেকে নানা পণ্ডিত ও ধর্মগুরুরা ব্রুনাইতে পা রাখেন। এ দেশের মানুষ তাঁদের মতবাদ ও ধারণা সাগ্রহে গ্রহণ করে। ক্রমশ ব্রুনাই-এর সুলতানি সাম্রাজ্য সুলু ও ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে বিস্তৃত হয়।
ব্রিটিশদের অধিগ্রহণ
১২৬৪ হিজরি সনে ব্রিটিশরা ব্রুনাইতে পা রাখে। তৎকালীন সুলতান ব্রিটিশদের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি সাক্ষর করেন। সেই চুক্তি অনুসারে ঠিক হয় যে ব্রিটিশদের সঙ্গে বাণিজ্যের সম্পর্ক স্থাপন হবে। এছাড়া ঠিক হয় ব্রুনাইয়ের চারপাশে প্রবল জলদস্যুদের প্রতিহত করতে সাহায্য করবে ব্রিটিশরা। ১৩০৬ হিজরিতে ইংল্যান্ড ব্রুনাইকে নিজেদের আশ্রিত রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করে। অতঃপর, ১৯৮৪ সাল তথা ১৪০৪ হিজরি সনের পয়লা জানুয়ারি বর্তমান সুলতান হাসান আল বোলকিয়াহর হস্তক্ষেপে ব্রিটিশ আশ্রয় থেকে মুক্তি পায় এই শান্তিপ্রিয় দেশ।
ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা
১৩৭২ হিজরি সনে তৎকালীন সুলতান তৃতীয় ওমর আলি সৈফুদ্দিন প্রভূত ভাবে দেশটির ইসলামীকরণ শুরু করেন। এর মধ্যে হজের জন্য ভর্তুকি প্রদান, সুন্দর সুন্দর মসজিদ ও প্রাসাদ নির্মাণ ও মাদ্রাসায় পড়াশুনোর প্রচলন অন্যতম। এছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল উত্তোলন ও সেই সংক্রান্ত শিল্প স্থাপনেও উন্নতি লাভ করে এই দেশ।
১৩৭৮ হিজরি সনে ব্রুনাইয়ের সরকারী ও জাতীয় ধর্ম হিসাবে ইসলাম গৃহীত হয়। ব্রুনাইতে এখনও রাজতন্ত্র চলে, এখনও দেশের প্রধান হিসাবে সুলতানকেই গ্রাহ্য করা হয়। সম্প্রতি ২০১৪ সাল তথা ১৪৩৫ হিজরি সনে বর্তমান সুলতান হাসাল আল বোলকিয়াহ এ দেশে শরিয়া আইন ও নীতি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক
১৩৮৩ হিজরি সনে মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি ‘ফেডারেশন অফ মালয়’-এ ব্রুনাইকে সংযুক্ত হতে অনুরোধ করে। এই দেশগুলির যুক্তি ছিল যে এরফলে ব্রুনাইয়ের প্রাকৃতিক সম্পদের মাধ্যমে সমস্ত দেশগুলির উন্নতি হবে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে ব্রুনাইকে তারা রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু তৎকালীন সুলতান ওমর আলি সসম্মানে সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। যদিও বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলির সঙ্গে এই দেশের সম্পর্ক খুবই মধুর, তবুও দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানায় নিজেকে স্বাধীন করেই রাখতে চায় এই শান্তিপ্রিয় ক্ষুদ্র দেশ।