ভারতে মুসলমান নারীদের স্বপ্নপূরণে সাহায্য করছে লেডবাই ফাউন্ডেশন

ভারতের ২০০ মিলিয়ন মুসলমান জনসংখ্যার মধ্যে অন্তত অর্ধেক নারী, এবং তাঁদের মধ্যে অন্তত দুই মিলিয়নের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। কিন্তু দিল্লির শাহিনবাগে, কলকাতার পার্ক সার্কাসে সিটিজেনশিপ আইনের বিরুদ্ধে যেভাবে মুসলমান নেত্রীরা গর্জে উঠেছিল, সেইরকম ভাবে কটা মুসলমান নারীকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়?
শুধু রাজনীতি নয়, যদি অর্থনৈতিক দিকেও তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে সেখানেও মুসলমান নারীদের অবদান বেশ কম। সেখানেই এগিয়ে এসেছে লেডবাই ফাউন্ডেশন (LedBy Foundation)-এর মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যারা মুসলমান নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির কাজে ব্রতী হয়েছে।
প্রশিক্ষণের নয়া দিগন্ত
শোনা যাক আম্মারা কাইজারের কথা, কাশ্মীরের এই মেয়েটির বয়স কুড়ি, পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছে আম্মারার, আর সেখানেই তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে লেড-বাই ফাউন্ডেশন। আম্মারা নিজে জানিয়েছেন এই সংস্থার হাত ধরেই তিনি ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়েছেন, শিখেছেন অনেক কিছু, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন এবং নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পেরেছেন।
‘আসলে মুসলমান নারীদের মধ্যে যোগ্যতা ও ট্যালেন্টের অভাব কোনওকালেই ছিল না, শুধু অভাব ছিল মাধ্যম, অধিগম্যতা বা সুযোগ ও উপায়।’ সংস্থার কর্ণধার ও প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার রুহা শাহদাবের অকপট মনের কথা এটি।
তিনি বিশ্বাস করেন ভারতীয় মুসলমান রমণীরা এক একজন সুযোগ্য উজ্জ্বল নেত্রী। তাঁদের পড়াশুনোর ইচ্ছে বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছের কোণও কমতি নেই। শুধু তাঁদের কাছে সঠিক উপায় ও সুযোগ পৌঁছে দিলেই তাঁরা পরিবর্তনে সামিল হতে পারবেন।
রুহা শাহদাব পেশায় ডাক্তার, ২০১৮ সালে পাবলিক পলিসি নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশুনো করতে তিনি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, সেখান থেকেই তিনি দেশের মুসলমান নারীদের উন্নতিকল্পে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করেন।
গোড়ার দিকে কথা
২০১৯ সালের মার্চ মাসে হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুল-এর এক সোশ্যাল ইনোভেশন অ্যান্ড চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভে তিনি প্রথম তাঁর ভাবনা চিন্তার ফল প্রকাশ করেন। তিনি প্রস্তাব রাখেন এমন এক উদ্যোগের যা ভারতীয় মুসলমান নারীদের প্রফেশনাল লিডারশীপের ট্রেনিং দেবে। প্রস্তাবটি সকলের পছন্দ হয়, তাঁকে এই বিষয়ে সম্পূর্ণ ফেলোশিপ দেওয়া হয়। সেখান থেকেই লেডবাই -এর ব্যাপারে পূর্ণদ্যমে কাজ শুরু।
‘প্রতিযোগিতা ছিল, বেশ অনেকগুলি ধাপ পেরিয়ে তারপর আমি সুযোগ পেয়েছিলাম।’ জানান রুহা ।
তারপরের কয়েকমাস বেশ অনেকখানি পরিশ্রমের পর লেডবাই তার যাত্রা শুরু করে।
রুহা শাহদাবের জন্ম , বড় হয়ে ওঠা সবই ভারতের দিল্লি শহরের নয়ডা অঞ্চলে। ডাক্তারি পড়ার পর তিনি ক্লিনটন হেলথ অ্যাক্সেস ইনিশিয়েটিভে কাজ করতে শুরু করেন, হার্ভার্ডে পড়তে যাওয়ার আগে তিনি ভারত সরকারের ‘নীতি আয়োগ’ প্রকল্পে কাজ করতেন।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যবিত্ত পরিবারে চাকরি পরিবর্তন একটা বেশ বড় ব্যাপার। সাধারণত পরিবারের বিশেষ সমর্থন থাকে না তাতে। কিন্তু রুহা শাহদাবের পরিবার সবসময়েই তাঁর পাশে ছিল।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, সব মুসলমান রমণীর পরিবার রুহার মতো নয়। বহুবছর ধরে চলে আসা প্রথা , রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান মেয়েদের বরাবর প্রকাশিত হতে দেয়নি। তাই জন্যই তাদের প্রকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে আজ আমরা কেউই অবগত নই।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ভারতের সর্বোচ্চ লাভজনক ৫০০টি কর্পোরেট কোম্পানির ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে হয়তো হাতে গুণে এক বা দুইজন মুসলমান নারীকে পাওয়া যাবে।
কর্পোরেট সেক্টরে একে মেয়েদের সংখ্যা কম, সেখানে মুসলমান মেয়ের সংখ্যা আরই কম। লেডবাই এই অসাম্যর সঙ্গেই লড়াই করতে চায়।
লেডবাই ফেলোশিপ আসলে কী?
সংস্থার মূল উদ্দেশ্য বুদ্ধিমতি ও যোগ্য কলেজ ছাত্রীদের ট্রেনিং এর মাধ্যমে কর্পোরেট লিডারে পরিণত করা।
এটি মূলত চারমাসের একটি সামার প্রোগ্রাম যেখানে যোগ্যতা অনুসারে ২৪টি মুসলমান মেয়েকে সুযোগ দেওয়া হয়।
প্রোগ্রামটির তিনটি ধাপ রয়েছে,
প্রথম ধাপে পনেরোদিন হার্ভার্ডের কোণও শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আলাপ আলোচনা ও চিন্তাশক্তির সঠিক প্রয়োগ শেখানো হয়। তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপ।
দ্বিতীয় ধাপের নাম ‘৩৬০ মেন্টরিং ডিগ্রি ফ্রেমওয়ার্ক’, এই ধাপে কম করে ছয়জন মেন্টরের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং শুরু হয়।
মেন্টররাও এক একজন নিজ ক্ষেত্রে সফল মুসলমান নারী। এই ওয়ার্কশপের শেষে শিক্ষার্থীকে নিজের কলেজ বা স্কুলের কোনও ছাত্রীকে মেন্টরিং করতে হয়।
তৃতীয় ধাপে শিক্ষার্থীকে নিজের সমাজ ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে পেশাগতভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা শিখতে হয়।
শাহিনা আতরওয়ালা, একজন সমাজকর্মী ও শিল্পী, এই বছর লেডবাইতে মেন্টরিং করেছেন।
তাঁর মতে, মুসলমান নারীদের সমাজের মূল ধারায় যুক্ত করতে ও দেশের উন্নতিকল্পে তাঁদের অবদান বাড়াতে লেডবাই ফাউন্ডেশনের কাজের কোণও বিকল্প নেই।
২০২০-এর ১৩ সেপ্টেম্বর লেডবাই প্রথম গ্র্যাজুয়েশন সেরেমনি বা স্নাতক সম্মান দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল, অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী শাবান আজমি ও মুসলমান নারী হিসাবে প্রথম নোবেল প্রাইজ বিজেতা ডক্টর শিরিন এবেদি।
ইবিতেসাম ফাতিমা , বছর ২২ এর এই মেয়েটি এই বছর লেডবাই ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রামে সুযোগ পেয়েছে। শাবানা ও শিরিনের সঙ্গে কথা বলতে পেরে সে উচ্ছ্বসিত, ফাতিমার বাড়ি পাটনা, খুব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। কিন্তু তাঁর ডেটা সায়েন্টিস্ট হওয়ার স্বপ্নের উড়ানে লেডবাই ফাউন্ডেশন তাঁর পাশে রয়েছে।