মধ্যযুগের ইসলামী বিশ্বে উদ্যান এবং উদ্ভিদের বিশ্বায়ন

মধ্যযুগের ইসলামী বিশ্বে মানুষ সবুজ গাছগাছালির প্রতি এমন মাত্রায় মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন, যা আজকের দিনে আমাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল।
নানা দেশের মুসলমানরাই বিভিন্ন বোটানিকাল উদ্যান এবং উদ্ভিদ সংগ্রহ স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
নীচে এ ওয়াটসনের একটি উক্তি উদ্ধৃত করা হল এগ্রিকালচারাল ইনোভেশন ইন দ্য আর্লি ইসলামিক ওয়ার্ল্ড থেকে; কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ১১৭-৮:
উদ্ভিদের প্রতি এই ভালোবাসা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে কবিতার এক বিশেষ ধরনের ঘরানায়, যা মূলত রদিয়া বা বাগিচা কবিতা (rawdiya or garden poem) নামে পরিচিত। এর উদ্ভব সম্ভবত ফারসি ভাষায়। এই ঘরানার কবিতাই অষ্টম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত আব্বাসীয় প্রাচ্যের অন্যতম প্রধান কাব্যিক রূপ হয়ে উঠেছিল।
মধ্যযুগের ইসলামী বিশ্বে বাগিচার প্রভাবঃ
এমনই একটি বাগিচা কবিতায় লেখক, ছায়ার শীতলতা, সুগন্ধীর দীর্ঘস্থায়িত্ব, বহমান জলধারার সংগীত, পাতাদের উচ্ছ্বলতা এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে অপার বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
নবম শতাব্দীর মধ্যে ওই কবিতার ঘরানা স্পেনে পৌঁছেছিল। সেখানে এই ধরনের কবিতা একাদশ শতাব্দীতে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে পৌঁছয়।
অধিকাংশ আরাবিগো-আন্দালুস কবিতার থিমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল উদ্যান।
এই কবিতায় ব্যবহৃত কথাগুলি নিছক শব্দ ছিল না; তাদের সাথে বাস্তবের গভীর মিল ছিল।
মধ্যযুগের ইসলামী বিশ্বে মুসলমানরা সর্বত্র এমন প্রশান্তিময় উদ্যান তৈরি করেছিল।
প্রাচীন ইসলামিক শহরগুলিতে নির্মীত এমন বিশাল ও বিস্তৃত উদ্যানের তালিকা করতে বসলে, তার জন্য কাগজ কম পড়তে পারে।
প্রাচীন ভৌগলিকরা বসরাকে বর্ণনা করেছিলেন প্রকৃত ভেনিস হিসাবে। সেখানে মাইলের পরে মাইলের বাগান ও ফুলের বাগিচা অতিক্রম করেছিল একাধিক খাল।
মেসোপটেমিয়ার একটি শহর নিসবিনে প্রায় ৪০,০০০ ফলমূলের গাছ এবং দামেস্কে ১১০,০০০ গাছ ছিল বলে জানা যায়।
আল-ফুস্তাত [প্রাচীন কায়রো] শহরে কয়েক হাজার ব্যক্তিগত উদ্যান ছিল, এবং তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি উদ্যান এমন ছিল যা দেখলে রীতিমতো তাক লেগে যেত।
কিছু দর্শনীয় বাগানঃ
সবচেয়ে দর্শনীয় বাগানগুলি হত শাসকদের। যেমন, সামাররার আল-মুনতাসিমের বাগান।
কায়রওয়ানের নিকটে অবস্থিত তিউনিসিয়ার অঘলাবিদ আমীরদের বিশাল রাজকীয় পার্ক এবং পরে তিউনিসিয়ার হাফসিদ শাসকদের দ্বারা নির্মীত বিখ্যাত উদ্যান।
মিশরের ফাতিমিদ খলিফা এবং তাঁর উজির আল-আফদালের বাগিচা।
ফেজ এবং মারাকেশের রাজপ্রাসাদের চারপাশের উদ্যানগুলি; স্পেনের প্রথম উম্মাইয়া আমীর আবদুল আল-রহমানের সুবিশাল বোটানিকাল গার্ডেন।
স্পেনের তাইফার রাজাদের বাগান এবং গজনির সুলতান মামুদের বালখ-এর বাগিচা ছিল দেখার মতো।
আরও একটি বিখ্যাত উদ্যান ছিল নবম শতাব্দীর শেষের দিকে মিশরের তুলুনিদ শাসক খুমারাওয়াইহ, যিনি পারস্যের ধাঁচে একটি সুবিশাল রাজকীয় উদ্যান তৈরি করেছিলেন।
আল-মাকরিজির মতে, এই বাগানের গৌরব ছিল খেজুর গাছ, যাদের কাণ্ডগুলি সোনা দিয়ে আবৃত করা থাকত।
সম্ভবত এই ভাবেই মুসলমান রাজাদের হাত ধরে পৃথিবীর একপ্রান্তের গাছ পৌঁছেছিল অপর প্রান্তে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্পেনের প্রথম উমাইয়াদ আমীর আবদুল আল-রহমান গাছপালার অনুরাগী ছিলেন।
তাঁর বাগানের জন্য তিনি নানা বিরল উদ্ভিদ সংগ্রহ করে এনেছিলেন।
এমনকী সিরিয়া এবং পূর্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে নতুন গাছ ও বীজ সংগ্রহের জন্য দূতও প্রেরণ করেছিলেন।
তাঁর বাগানের মাধ্যমেই স্পেনে এক নতুন ধরনের ডালিমের প্রচলন হয়েছিল।
খেজুর গাছের প্রসারঃ
খেজুর গাছও এই অঞ্চলে এসেছিল আল-রহমানের হাত ধরেই। দশম শতাব্দীর মধ্যে, কর্ডোবার রাজকীয় উদ্যানগুলি বোটানিকাল উদ্যানে পরিণত হয়েছিল।
সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বীজ, কাটিং এবং শিকড় নিয়ে এসে গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল। স্পেন এবং অন্য দেশের রাজকীয় উদ্যানগুলি বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকলাপের পাশাপাশি বিনোদনের জায়গাতেও পরিণত হয়েছিল।
সম্প্রতি আবিষ্কৃত আল-উধ্রির একটি ভৌগলিক পাণ্ডুলিপিতে লেখকের বর্ণনা রয়েছে, যে আল-মু’তাসিম নামের একজন তিফা রাজা তাঁর আলমেইরার বাগানে বহু বিরল গাছ নিয়ে এসেছিলেন।
আবার ইসলামী বিশ্বের অন্য প্রান্তে, তাবরিজে ইল-খানদের বাগানে ভারত, চীন, মালয়েশিয়া এবং মধ্য এশিয়া থেকে বহু বিরল ফলের গাছ নিয়ে গিয়ে বসানো হয়েছিল।
মধ্যযুগের ইসলামী বিশ্বে অনেক স্থানেই উদ্ভিদ গবেষণা এবং কৃষির উদ্ভাবনের প্রতি রাজকীয় আগ্রহের ফলে কয়েক শতাব্দীর মধ্যে কৃষিকাজ ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল।
বহু ইসলামী দেশের সুলতান যাঁরা উদ্ভিদ ও কৃষি গবেষণা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কৃষি সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
এই উদ্যোগগুলির কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝা যায় আরও একটি বিষয়ে। সেটি হল, এই ধরনের জাতীয় উদ্যানগুলির অধিকাংশেরই দায়িত্বে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা।
ইল-খানসের ছিলেন এক পার্সিয়ান উদ্ভিদবিজ্ঞানী, যিনি ফলের গাছের গ্রাফটিংয়ের উপর একটি বই লিখেছিলেন, আল-তিগনারি।
স্পেনে সদ্য পা রাখা নতুন উদ্ভিদের নাম ও ব্যবহারে ব্যাখ্যার জন্য একটি সরল বই লিখেছিলেন ইবন ওয়াফিদ।
এভাবেই মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্বে উদ্যান এবং বিশেষত রাজকীয় উদ্যানগুলি হয়ে উঠেছিল এমন জায়গা, যেখানে ব্যবসার সাথে মিশে যেত আনন্দ।
বিজ্ঞানের সাথে বন্ধুত্ব হত কলাবিদ্যার।
এর বহু শতাব্দী পরে ইউরোপে একই ধরনের বোটানিকাল গার্ডেন গড়ে উঠেছে। কিন্তু মুসলিমরাই যে এই ক্ষেত্রে প্রথম নজির স্থাপন করেছিল, তা অনস্বীকার্য।