মধ্য এশিয়ায় ইসলামের আগমন ও তাকে দমনের একাধিক প্রচেষ্টা

আধুনিক মধ্য এশিয়া গঠিত পাঁচটি প্রজাতান্ত্রিক দেশের সমন্বয়ে, সেগুলি হল- কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তান। এর পশ্চিম দিকে রয়েছে ক্যাস্পিয়ান সাগর, পূর্ব দিকে চীন, দক্ষিণে ইরান, আফগানিস্তান, দক্ষিণে পাকিস্তান এবং উত্তরে রয়েছে রাশিয়া। কখনও কখনও চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল শিনচিয়াং (Xinjiang) এবং আফগানিস্তানকে মধ্য এশিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে তাদের কোনও ভাবেই এই পাঁচটি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে একাত্ম করা যায় না।
এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে যাযাবর প্রজাতির লোকজনের সাথে যুক্ত। তাঁরা সেই এলাকায় বসবাস করতেন যার মাধ্যমে ইউরেশিয়া জুড়ে বিবিধ পণ্য ও দেশের লোকেরা যাতায়াত করত। তবে বর্তমানে বিশ্বের এই বিশেষ এলাকা সম্পর্কে খুবই কম জানা ও বোঝা যায়। এর পিছনে যে কারণগুলি রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – সিল্ক রোডের অবসান এবং ইসলামের সাথে তাদের যোগ।
মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের ভৌগলিক অবস্থান
ভৌগোলিকভাবে এই পাঁচটি দেশকে তিনটি জোনে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথমটি হল, ওয়েসিস বেল্ট, যা ট্রান্সওক্সিয়ানা বা ট্রান্সওক্সানিয়া নামেও পরিচিত। এটি মূলত উজবেকিস্তানে, তবে প্রতিবেশী দেশগুলির কিছু অঞ্চলেও বিস্তৃত, দ্বিতীয় হল কাজাখস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের স্টেপ-মরুভূমি অঞ্চল; এবং তৃতীয়, দক্ষিণ-পূর্ব তাজিকিস্তানের উচ্চ পর্বত অঞ্চল। এই তিনটি অঞ্চল বিভিন্ন সময় এবং ভিন্ন ভাবে ইসলামের সাথে পরিচিত হয়েছিল। তাছাড়া এই তিনটি অঞ্চলের জাতিগত ঐতিহ্য ছিল ভিন্ন।
৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, ওয়েসিস বেল্টে মূলত ইরানী ও তুর্কি বংশোদ্ভূতদের বাস ছিল। পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকা সিল্ক রোড সংলগ্ন এই এলাকায় মেরভ, সমরখন্দ এবং বুখারার মতো সমৃদ্ধ শহুরে অঞ্চল ছিল। জোরোস্ট্রিয়ানিজম, বৌদ্ধধর্ম এবং ম্যানিকাইজম-সহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা সেখানে থাকতেন। অল্প সংখ্যক অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ছিলেন কিছু নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান এবং ইহুদি। বর্তমানে তুর্কমেনিস্তান নামে পরিচিত এলাকার বাসিন্দারা মূলত হেলেনীয় মতে বিশ্বাসী ছিলেন।
ইসলামের বিজয়রথ
অষ্টম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ায় ইসলামের প্রসার এবং বিজয় অভিযান শুরু হয় মুসলিম সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের অংশ হিসাবে। ৬৫১-৬৫২ খ্রিস্টাব্দে, উত্তর-পূর্ব ইরান, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান এবং উত্তর আফগানিস্তানের বিশাল অঞ্চল যা খোরাসান নামে পরিচিত, তা মুসলমানরা জয় করেছিল। ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় গভর্নর কুতায়বাহ ইবনে মুসলিম মেরভ শহরে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখান থেকে তিনি একাধিক বার ফারঘানা উপত্যকায় অভিযান চালিয়েছিলেন।
বর্তমান কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তানের সীমান্তে তালাসের যুদ্ধ হয়েছিল ৭৫১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। এখানে চীনা তাং রাজবংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল আব্বাসীয় খিলাফত এবং তিব্বত সাম্রাজ্য। এই যুদ্ধের ফলে পরবর্তী ৪০০ বছর এই অঞ্চল মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তুর্কি উপজাতি কার্লুক্স-এর পতনের পরে এই এলাকা পুরোপুরি মুসলিম শাসনের অধীনে চলে আসে। ফলে, খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর শুরুতে, ওয়েসিস বেল্ট পুরোপুরি মুসলিম বিশ্বের অংশে পরিণত হয় এবং ৮১৩ থেকে ৮১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাগদাদের পরিবর্তে মেরভ ছিল খলিফা মা’মুনের রাজধানী। এখন মেরভ শহরের অস্তিত্ব না থাকলেও, বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের মেরি শহরের নিকটে অবস্থিত ছিল তৎকালীন মেরভ।
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, ৫,০০,০০০ জনসংখ্যাবিশিষ্ট মেরভ শহর বিশ্বের বৃহত্তম শহরগুলির অন্যতম হয়ে উঠেছিল। ১২২১ সালে মোঙ্গল সেনা এই শহর ধ্বংস করে। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, এই সময়ে শরণার্থী-সহ ১০ লক্ষ বাসিন্দাকে হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনার ছয় বছর পরে চেঙ্গিস খান মারা যান। তখন তাঁর সাম্রাজ্যের প্রসার ছিল উত্তর-পূর্ব চীন থেকে ক্যাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত। মেরভ পুরোপুরি পূর্বাবস্থায় ফিরে না গেলেও, ইসলাম সেই বর্বর বিজয় অভিযানের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল, এবং ক্রমশ তা বাকি সাম্রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
প্রথম মোঙ্গল যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খানের নাতি বরাকা (বার্কে) খান। তাঁর বংশধর তৈমুর লং এই অঞ্চলে ইসলামকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। একদা যারা মুসলিমদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল, পরে তারাই ইসলামের রক্ষকে পরিণত হয়েছিল।
বাণিজ্য রুট হস্তগত করার প্রচেষ্টা
খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া ক্রমশ বাকি মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করেছিল। এই অঞ্চলটির কোনও স্বতন্ত্র সীমানা না থাকলেও সিল্ক রোডের বেশ কয়েকটি প্রধান রুট ছিল, যা যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হত। যাই হোক, পরে ভারত, চীন এবং ইউরোপের মধ্যে দ্রুততর বিকল্প বাণিজ্য রুট হিসেবে সামুদ্রিক রুট তৈরি হলে অঞ্চলটি অশান্ত হয়ে ওঠে। উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বহু গোষ্ঠীভিত্তিক উপজাতি এই অঞ্চল শাসন করেছিল। তবে কারও শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
রাশিয়ার জার সাম্রাজ্য সপ্তদশ শতকে মধ্য এশিয়া জয়ের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। খ্রিস্টীয় ১৯ শতকে মধ্য এশিয়ার উপরে কর্তৃত্ব স্থাপন নিয়ে লন্ডন এবং সেন্ট পিটার্সবার্গের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল, যা ইতিহাসের পাতায় গ্রেট গেম নামে খ্যাত। প্রতিটি স্বাধীন উজবেক অঞ্চল দখল না করা পর্যন্ত রুশ অভিযান অব্যাহত ছিল। বর্তমান উত্তর কাজাখস্তান ছিল প্রথম অঞ্চল যেটি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে এসেছিল, এবং এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ রাশিয়া সম্পূর্ণ ওয়েসিস বেল্টের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে এবং পরবর্তী এক দশকের সমগ্র এলাকা পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েছিল।
মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা
স্টেপ এলাকায়, জারশাসিত রাশিয়া ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি সদ্ব্যবহার করেছিল। তারা মুসলিম সাহিত্য মুদ্রণ এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল। স্টেপস অঞ্চলে যাযাবরদের জন্য কয়েকটি মসজিদ ছিল। ওয়েসিস বেল্টের মুসলমানদের উৎসাহিত করা হয়েছিল যাতে তারা যাযাবরদের প্রশিক্ষণ ও নির্দেশ প্রদান করে আরও সাচ্চা মুসলমান করে তুলতে পারে। শীঘ্রই কাজাখ যাযাবররা বুঝতে পেরেছিল, যে ইসলামের এই ‘নতুন’ রূপের সাথে তাঁরা সম্পূর্ণ অপরিচিত। খ্রিস্টীয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জারের বিভিন্ন নীতির পরিবর্তন হতে থাকে। তখন তারা খ্রিস্টান মিশনারিদেরকে স্টেপ অঞ্চলে প্রেরণ করতে শুরু করে এবং ওয়েসিস বেল্ট এলাকায় ইসলামী রীতিনীতি পালনের উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
রুশ বিপ্লবের পরে, ১৯১৭-১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়া পরিণত হয় সোভিয়েত রাশিয়ার (USSR) অংশে। আজ আমরা যে পাঁচটি প্রজাতন্ত্রের সাথে পরিচিত, সেই কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তান হিসেবে তাদের গঠন করা হয়েছিল। তবে রুশ সরকার এই এলাকার মুসলিমদের প্রতি সদয় ছিল না। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই পাঁচটি প্রজাতন্ত্র পৃথক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।