আকাশে ওড়ার স্বপ্ন কে প্রথম দেখিয়েছিল মানুষকে?

জ্ঞানচর্চার এষণা এবং কৌতূহল নিবৃত্তির ধারাবাহিকতায় সৃজনশীল সৃষ্টিশীল মানুষের প্রকাশ এবং ব্যাপ্তি বহুমুখী। সৃষ্টিশীলতার ইতিহাসে ইসলামী সভ্যতা এবং সংস্কৃতির প্রকাশও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আগুন আবিষ্কারের পরবর্তী সময় থেকেই বোধহয় মানুষ অজানা, অদেখা বিষয়কে আরও গভীরভাবে জানতে এবং চিনতে শিখেছে, চেষ্টা করেছে।
মানুষ যেদিন থেকে হাঁটতে শিখছে, খাদ্যশস্য আহরণ এবং জীবিকা নির্বাহের বহুবিধ সংস্থানের পথ খুঁজে বের করেছে সেদিন থেকেই নীল আকাশে মুক্ত-স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। গল্পকথা এবং রূপকথার ভিড়ে লুকিয়ে রয়েছে ওইসকল কল্পনাবিলাসের বহুবিধ ইতিবৃত্ত।
আইকারাসের কথাই ধরা যাক না! আইকারাস না কি সূর্যের কাছাকাছি উড়তে চেয়েছিলেন, লক্ষ্য পূরণে পালক দিয়ে নিজের ডানাজোড়া বানালেও সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। প্রাথমিকভাবে তাঁর উড়ান সফল হলেও সূর্যের তাপে পালকের সঙ্গে সংযুক্ত মোম গলতে শুরু করে এবং মাটিতে পড়ে তাঁর প্রচেষ্টা বিফলে যায়। গল্পকথার পরিসর থেকে বেরিয়ে এসে শোনা যায় খ্রিপূর্ব পঞ্চম শতকে একজন চিনা ব্যক্তি আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথম সফল প্রয়াস নিয়েছিলেন।
আকাশে উড়তে চেয়েছিলেন কে প্রথম?
তবে ঐতিহাসিক সত্যতার নিরিখে, সভ্যতার বিচারে মানুষ হিসেবে প্রথম আকাশে উড়ার ইতিহাসসৃষ্টিকারী ব্যক্তি হচ্ছেন স্পেনের কর্ডোভা নিবাসী একজন মুসলমান, নাম আব্বাস ইবন ফিরনাস। বলাবাহুল্য একজন মুসলমান জৈনিক ব্যক্তিই সর্বপ্রথম মানুষের দেখা স্বপ্নগুলো পূরণে সফল হয়েছিলেন। বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী আব্বাস ইবন ফিরনাস ছিলেন একজন আবিষ্কারক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক এবং আরবি কবি। আব্বাস ইবন ফিরনাস ছিল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসাপূর্ণ মনন এবং চিন্তাধারা। গণিত, জ্যোর্তিবিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যার মতো বিষয়ে ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। প্রচলিত উপাখ্যান থেকে জানা যায় ইবন ফিরনাস ৮৫২ সালে আরমেন ফিরম্যানের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন।
ওড়ার পদ্ধতিঃ
আরমেন ফিরম্যান বিজ্ঞানী না হয়েও প্রকৃতিকে নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কাঠকে ব্যবহার করে রড আকৃতির আড় দিয়ে উপরে রেশমকাপড় জড়িয়ে একটি উড্ড্য়ন যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। এই যন্ত্র নিয়ে আরমেন ফিরম্যান কর্ডোভার মসজিদের মিনারে উঠে যন্ত্রসংযোজিত হয়ে লাফ দেন।
তিনি উড়তে পারেননি, ক্রমশই নিচে পড়তে থাকেন, কিন্তু সিল্ক বস্ত্রটি ফুলে ফেপে উঠায় তাঁর অবতরনের গতি কমে যায়, ফলে তিনি সামান্য আঘাত প্রাপ্ত হলেও তাঁর মৃত্যু হয়নি। এটিই সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম প্যারাসুট নিয়ে লাফ দেওয়া বলা যায়।
ইবন ফিরনাস তখন ভিড়ের মধ্যে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন এবং এই ফলাফলে বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
প্রাথমিকভাবে তিনি এক জোড়া কাঠ আর রেশম কাপড় নিয়ে সেগুলো সুচ সুতো দিয়ে সেলাই করে পাখা তৈরি করেন। পরে তিনি জাবাল আল-আরস পর্বতের শৃঙ্গ থেকে ঝাঁপ দেন এবং বেশ কিছু সময় উড়তে থাকেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে তিনি প্রায় ১০ মিনিট উড়তে পেরেছিলেন। ইবন ফিরনাস উড্ডয়নের কৌশলের দিকেই বেশি মনোযোগ নিবদ্ধ করেন, কিন্তু অরম্যানের কৌশলের দিকে তাঁর মনোযোগ ছিল না। তিনি পৃথিবীর দিকে অবতরণ করতে থাকলেও গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি এবং প্রবল গতিতে নামতে গিয়ে ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে প্রবলভাবে আঘাত প্রাপ্ত হন।
এই ঘটনার পরও ইবন ফিরনাস আরও ১২ বছর জীবিত ছিলেন। সেই সময়ে তাঁর নকশায় ঠিক কী ভুল হয়েছিল তা সনাক্তকরণের প্রচেষ্টা চালান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর নকশায় অবতরণের সময় গতি কমানোর কোন যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযুক্ত ছিল না। একটি পাখি লেজ এবং ডানাগুলোকে সমন্বিতভাবে কার্যক্ষম রাখে, ফলে এটি ভূমি স্পর্শ করার আগে আকাশে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। ইবন ফিরনাস উপলব্ধি করলেন যে, তিনি তাঁর উড্ডয়ন যন্ত্রে কোন লেজ রাখেননি।
ইবন ফিরনাস তাঁর জীবদ্দশায় আর উড়তে পারেননি।
উল্লেখ্য যে, ইবন ফিরনাস কেবল আকাশে উড়ার স্বপ্নই দেখেননি এবং তা শুধুমাত্র ফলপ্রসূতেই সচেষ্ট হননি, তিনি ঘূর্ণনক্ষম গ্রহ নিয়ে যান্ত্রিক প্ল্যানেটোরিয়ামও তৈরি করেন। এর বাইরে তিনি যান্ত্রিক বস্তু, সময় যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। রত্ন, স্ফটিক নিয়েও তাঁর কৌতূহল ছিল, বালি গলিয়ে আন্দালুসিয়ার বিশেষ পানীয় গ্লাস তিনি আবিষ্কার দেন। গ্লাস থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস ও লেন্স নিয়েও তিনি তাঁর পরীক্ষা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আব্বাস ইবন ফিরনাসের এই বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রভাব লক্ষ করা যায় লিও-নার্দো-দ্য-ভিঞ্চির পরবর্তী বিমান তৈরির প্রকল্পে।
পরবর্তীকালে Working Group for Planetary System Nomenclature (IAU/WGPSN) ১৯৭৬ সালে ইবন ফিরনাসের অসামান্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ চন্দ্রের একটি ক্রেট বা গর্তের নামকরণ করে ইবন ফিরনাস। পরিবেশে বলা যায় মুসলমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পরিমণ্ডলে অগাধ ব্যক্তিত্বের অধিকারী আব্বাস ইবন ফিরনাসের ভূমিকা অপরিসীম, যা ইসলামীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রসার পথে কাঙ্ক্ষিত এবং ইতিসূচক।