যুহুদ: ভোগবাদী সংস্কৃতির উত্তম প্রতিষেধক

বর্তমানে আমাদের বৈশ্বিক উত্পাদনশীলতার অন্যতম প্রধান শত্রু হল আরামদায়ক ভোগবাদী সংস্কৃতি; যা আজ বিশ্বব্যাপী ছেয়ে গেছে। সবকিছুই হাতের নাগালের মধ্যে চলে আসার দরূণ আমরা দ্রুত ও আরামদায়কভাবে সবকিছু পাওয়ার চিন্তা করছি! বিলাসিতার রূপ এমন ভয়ংকার আকার ধারণ করেছে যে, একটু শারীরিক বা মানসিক কষ্ট সহ্য করার সাহসও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় হল যুহুদ বা দুনিয়া বিমুখতা। যার চেতনা প্রতিটা মুসলিমের মধ্যেই জাগ্রত হওয়া উচিত।
আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন এই পৃথিবীকে অপরুপ সৃষ্টিকুল দিয়ে সাজিয়েছেন। সকল সৃষ্টিকেই মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু তারপরও সব কিছুকে মানুষের জন্য ভোগ করার সুযোগ দেননি। মহান আল্লাহ সবকিছুর জন্যই একটা সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ কোনো সীমানার প্রতি দৃষ্টিপাত না করেই তার মন মত দুনিয়ার জীবন কাটাচ্ছে। যার ফলে তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিষয়ের প্রতি এই নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। আর তা হল যুহুদ বা দুনিয়া বিমুখতা।
যুহুদ অর্থ কি?
যুহুদ আরবী শব্দ। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে কষ্ট সহ্য করা, দুনিয়া বিমুখতা ইত্যাদি।
অনেকেই দুনিয়া বিমুখতার মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকে তারা বলে থাকে দুনিয়া বিমুখতা বলতে পৃথিবীর প্রতি আকৃষ্টকারী সব কিছু থেকে বিমুখ হতে হবে যা ‘সন্নাসী জীবন’ নামে পরিচিত। কিন্তু ইসলামে সন্নাসীপনার কোন স্থান নেই। কুরআন-হাদিসে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান বর্ণীত হয়েছে।
তাহলে দুনিয়া বিমুখতা বলতে প্রকৃতপক্ষে কি বোঝায়? আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,
“আর তারা দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট অথচ পার্থিব জীবন আখিরাতের তুলনায় ক্ষনস্থায়ী ভোগ মাত্র” (আল কুরআন-১৩:২৬)
“বরং তারা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছে,অথচ আখেরাতের জীবনই হল স্থায়ী।” (আল কুরআন-৮৭:১৭)
এ সকল আয়াতের বাস্তব প্রতিফলন আমরা বর্তমান সমাজে দেখতে পাচ্ছি। প্রায় সকল মানূষই দুনিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অথচ দুনিয়ার জীবন হচ্ছে খুবই সংক্ষিপ্ত।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেন, “আমি মানুষের মধ্যকার অনেককে পরিক্ষা করার জন্য পার্থিব জগতের যে ভোগ বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, আপনি সে সকল বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেননা, আপনার পালন কর্তার দেওয়া রিযিকই উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।” (আল কুরআন-২০:১৩১)
উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে যুহুদ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল, আর তা হল দুনিয়াকে নিয়ে নয় বরং আখিরাতকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা।
দুনিয়া বিমুখতার কয়েকটি স্তর
দুনিয়া বিমুখতার চারটি স্তর রয়েছে। সেগুলি নিম্নরূপ
১) হারাম থেকে বিমুখতাঃ দুনিয়াবিমুখতার এই স্তরটি প্রতিটা মুসলিমের জন্য অত্যাবশ্যক।
২) অপছন্দনীয় কার্যাদী থেকে বিমুখতাঃ দুনিয়াবিমুখতার এই স্তরটি নফল ও পছন্দনীয় পর্যায়ের।
৩) বৈধ কাজে সীমাতিরিক্ত ব্যস্ত হওয়া থেকে বিমুখতাঃ দুনিয়াবিমুখতার এই স্তরটি প্রশংসনীয়। এর উদাহরণ হল, অসার কথা, অযথা প্রশ্ন করা থেকে বেঁচে থাকা ইত্যাদি। এরকম বিমুখতা একজন মুসলিমের বিশেষ পরিপূরক গুণ।
৪) মহান আল্লাহ ব্যাতীত অন্য সকল কিছু এবং আল্লাহ থেকে বিমুখকারী সকল কিছু থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়া। আর দুনিয়াবিমুখতার এই স্তরটিই হল পরিপূর্ণ স্তর। যা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত।
রাসূল (সাঃ)-এর উদাহরণ
এখন আমরা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করে তাঁর দুনিয়া বিমুখতার কিছু উদাহরণ দেখব যা দ্বারা প্রতীয়মান হবে যে, তিনি দুনিয়া বিমুখী হিসেবে কেমন ছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাঁর উভয় পা মোবারক ফুলে যায়; এমন কি তাঁর পা ফেটে পর্যন্ত যায়। এক সাহাবী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“আল্লাহ কি আপনার পূর্বের এবং পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেননি? এরপরও আপনি এত কষ্ট করেন!” তিনি বললেন, “আমি কি আল্লাহর অধিক শুকরিয়া জ্ঞাপন কারী বান্দা হব না?” (বুখারী)
দেখুন তিনি কি পরিমাণ ইবাদতে মগ্ন থাকতেন যে, তাঁর পা ফুলে ফেটে যেত।
উমার (রাঃ) বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রবেশ করে তাঁর শরীরে চাটাইয়ের চিহ্ন দেখতে পেলাম এবং একটা পাত্রে এক সা পরিমাণ (দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম) যব দেখতে পেলাম। তখন আমার চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে গেল। তিনি বললেন, “হে ওমর তুমি কান্না করছ কেন??” তখন আমি বললাম, “আমি কান্না কেন করব না? আপনার খাবারের পাত্র এমন আর কিসরা ও কায়সারের (তৎকালীন রোম ও পারস্য) শাসকদের দস্তরখান ফলমূলে পরিপূর্ণ থাকে। অথচ আপনি হলেন আল্লাহর রাসূল।” তখন তিনি বললেন, “হে ওমর, এই দুনিয়াটা হচ্ছে তাদের জন্য আর আখিরাতটা হল আমাদের (মুমিনদের) জন্য।” (মুসলিম)
উল্লেখিত আয়াত এবং হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দুনিয়ার এই জীবন খুবই নগন্য যার মূল্য আল্লাহর নিকটেও নেই এবং তাঁর রাসূলের নিকটেও নেই। তাই এই নগন্য জীবনের পিছনে মগ্ন হয়ে বিলাসিতার চরম পর্যায়ে পৌছানো যে কতটা বোকামী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ আমাদেরকে এই ভোগবাদী মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসে প্রকৃত দুনিয়া বিমুখতার তৌফিক দান করেন। আমীন