ল্যুভর আবু ধাবি মিউজিয়াম: বিশ্বের সংগ্রহশালার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র!

“পঞ্চাশ বছর আগেও সাদিয়া দ্বীপের ২৭ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল ছিল সমুদ্র ও আকাশ সন্নিহিত প্রায় জনবিরল অঞ্চল। অল্প কয়েকজন যারা এই দ্বীপে বাস করতেন, তাদেরকেও পানীয় জলের জন্য নৌকো করে মূল ভূখণ্ডে আসতে হত। আর আজ দেখুন, বিশ্বাস হয় সেই কথা?” আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে কথাটা বলল ওমর। ওমর আমার গাইড, ঝকঝকে এক তরুণ সে। তাকে সঙ্গে নিয়ে আজ আমি দেখতে এসেছি আরব আমিরশাহীর সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর নতুন নিদর্শন- ল্যুভর আবু ধাবি মিউজিয়াম।
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে আরব আমিরশাহীর পর্যটন ও সংস্কৃতি বিভাগ সাদিয়া দ্বীপে প্রথম ল্যুভর আবু ধাবি মিউজিয়াম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় ও তা কার্যকরী করে। তৎকালীন ফরাসী রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর উপরাষ্ট্রপতি মহম্মদ বিন রশিদ আল মাক্তুম ও যুবরাজ মহম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিন একযোগে এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। আমিরশাহী বরাবর সংস্কৃতি ও শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক, ২০১০ সালে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় এখানে একটি শাখা স্থাপন করে। এছাড়া আরও সংগ্রহশালা ও অপেরা হাউজের পরিকল্পনাও রয়েছে পর্যটন বিভাগের।
ল্যুভর আবু ধাবি মিউজিয়াম-এর পরিকল্পনা:
ল্যুভর আবু ধাবি সংগ্রহশালার বৈশিষ্ট্য হল সমুদ্র ও ভূমির অনবদ্য সংযোগ! সংগ্রহশালার স্থাপত্যের মধ্যেই ঈঙ্গিত পাওয়া যায় সমুদ্রের গভীরতার। ফরাসী স্থাপত্যবিদ জাঁ নোউভেলের পরিকল্পনায় সম্পূর্ণ স্থাপত্যটি তৈরি হয়েছে। সমুদ্র, আলো, আধুনিক শিল্প ও জ্যামিতিক আকারের অনবদ্য ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায় সংগ্রহশালার প্রতি কোণে। এর সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে মিশে গিয়েছে আরব আধুনিকতা ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গ। যাদুঘরের ভিতরের জানলাগুলি পর্যন্ত এমনভাবে তৈরি যে দেখলে হাতে আঁকা ছবি বলে ভ্রম হয়। স্থাপত্যের মধ্যে প্রবহমান শীতল জলের অবস্থান ইসলামে ‘ফলজ’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়।
মদিনার আদলে তৈরি এই স্থাপত্য দর্শকদের চোখে একেবারে অন্যমাত্রার হয়ে ধরা দেয়। ইসলামে কথিত আছে, অতীত থেকে ধারণা নিয়ে বর্তমানে প্রযুক্তির সাহায্যে তা সম্পন্ন করো। এই মিউজিয়াম সেই কথনের প্রকৃত উদাহরণ।
সবচেয়ে ভাল লাগে, প্রত্যেকটা গ্যালারি, প্লাজা এমনকি সংগ্রহশালার কার্যালয়ে পর্যন্ত আন্তরিকতার ছাপ। স্থাপত্যের মধ্যে পা রাখলে শুধুমাত্র বৌদ্ধিক অভিজ্ঞতা হয় তা নয়, বরং রুহ বা আত্মার সঙ্গেও যেন সংযোগ স্থাপন করে প্রতিটি ঐতিহাসিক নিদর্শন।
নোউভেলের ডোম বা গম্বুজ:
ল্যুভর আবু ধাবি মিউজিয়াম-এর মধ্যে সবার আগে নজরে আসে এই আশ্চর্যসুন্দর গম্বুজটি। ফরাসী স্থপতি অত্যন্ত পড়াশুনো করে যে পরিকল্পনা করেছেন তার প্রমাণ এখান থেকেই পাওয়া যায়। গম্বুজটিকে অনায়াসে ইসলামী স্থাপত্যের প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মান বলা চলে। এই ইসলামী স্থাপত্যকে বলা হয় ‘মাশরাবিয়া’।
তীব্র সূর্যালোককে প্রতিহত করে অল্প আলো-ছায়া ঘেরা একটি স্থান তৈরি করে এই ধরনের স্থাপত্য। স্থপতিদের ভাষায় একে ‘ভাসমান গম্বুজ গঠনপ্রণালী’ও বলা হয়।
গম্বুজটির মূল উদ্দেশ্য মরূদ্যানের উপর খেজুর গাছের পাতা যেমন আলোর ঝিকিমিকি তৈরি করে, ঠিক তেমন পরিবেশ তৈরি করা মিউজিয়ামের মধ্যে। ফলে, মোট ৮০০০ চৌকো ও অষ্টকোণী জ্যামিতিক আকার একে অপরের সঙ্গে বিভিন্নভাবে বুনে এই গম্বুজ বানানো হয়েছে। বুননের নকশা এমনই যাতে নিখুঁত মাপা ফাঁক থাকে প্রতিটি জ্যামিতিক গঠনের মধ্যে। সেই ফাঁক দিয়ে দিয়ে সূর্যালোক সংগ্রহশালার মেঝেতে ও দেওয়ালে নানা জ্যামিতিক নকশা তৈরি করে। মিউজিয়ামের কর্মীরা একে ‘আলোর বর্ষণ’ বলতেই পছন্দ করেন বেশি। অল্প সূর্যালোক, বেশ খানিকটা সমুদ্রের বাতাস এই ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে বলে ল্যুভর আবু ধাবি মিউজিয়াম- এর মধ্যে যেন প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি হয়। সেই পরিবেশে মানুষ আরও অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারেন নিজেদের ইতিহাসকে।
মিউজিয়ামের ডিরেক্টর ম্যানুয়েল র্যাবাতি জানান, ‘মারওয়া দ্বীপ থেকে প্রথম পাঁচ হাজার বছরের পুরনো মেসোপটেমিয়ার ফুলদানি পাওয়া গিয়েছিল। সেটিই হল আমিরশাহীর প্রথম প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। এরপরে আস্তে আস্তে খনন শুরু হয় ও বোঝা যায় যে মধ্যপ্রাচ্য আদতে নানা সময়ে নানা ঐতিহাসিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সেই সমৃদ্ধ ইতিহাসই তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে এখানে।’
ল্যুভর আবু ধাবি মিউজিয়াম-এর গ্যালারি:
ল্যুভর আবু ধাবি মিউজিয়াম-এর প্রবেশ দরজাটি খুব সাধারণ কাঠের সাদা দরজা। কিন্তু সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করার পরেই এক অন্য দুনিয়া আমাদের চোখের সামনে খুলে যায়। মনে হয় প্রাচীন এক শহরে প্রবেশ করছি, যে শহর নিজের সব রহস্য উজার করে দেবে আমাদের চোখের সামনে। আপাতত সংগ্রহশালায় বারোখানা গ্যালারি রয়েছে। প্রত্যেকটি গ্যালারি অনুপম ধাঁচের ও তার মধ্যে সংগ্রহীত দ্রব্যগুলিও অন্যরকম। বারোখানা গ্যালারি এমনভাবে সজ্জিত যে মনে হয় একটি প্রাচীন বইয়ের এক একটি অধ্যায় পাঠ করছি। আসলে, ল্যুভর আবু ধাবির মূল উদ্দেশ্য সার্বজনীর ইতিহাসকে মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরা।
ডিরেক্টর রাবাতি জানান, ‘ ল্যুভর আবু ধাবি সার্বজনীন ইতিহাস ও দর্শনকে তুলে ধরতে চায়। আর তা স্পষ্ট বোঝা যায় গ্যালারির সজ্জা ও তার মধ্যে রক্ষিত সংগ্রহগুলি থেকে।’
প্রতিটি গ্যালারির আকার অন্য ধাঁচের, এমনকি দেওয়াল ও মেঝের রঙ অবধি আলাদা রকমের। এ যেন জাঁ ফ্রান্সিস শার্নিয়ারের কথার মূর্ত প্রতিচ্ছবি, ‘পরিচয় যেন পার্থিব নানা বিষয়ের সঙ্গে আদান প্রদানের ফলাফল।’
ক্যালিগ্রাফি ও মানচিত্রের সম্ভার
প্রথম গ্যালারিতে প্রবেশ করলেই চোখ টানে নটি লম্বা ক্যানভাসে রচিত ক্যালিগ্রাফি। আমেরিকান চিত্রশিল্পী সাই টোম্বলির এই শিল্পটির নাম “ইমোশনাল ক্যালিগ্রাফি”। এই শিল্পকর্মে তিনি পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে ইসলামের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ক্যালিগ্রাফির সম্পর্ক তুলে ধরেছেন।
এরপরে চোখ টানে ‘দ্য গ্র্যান্ড ভেস্তিবিউল’। নানা প্রকার লিখন ও বস্তুর মাধ্যমে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে গ্যালারি। নটি ডিসপ্লে কেসের মধ্যে নানা সভ্যতার নিদর্শন। রয়েছে সংযুক্ত আমির আরবশাহীর প্রাচীন মানচিত্র, যাতে রয়েছে শহর ও লোকালয়গুলির প্রাচীন নাম। ভেস্তিবিউলের মধ্যে রয়েছে একটি মার্বেলের তৈরি কম্পাস উইন্ডরোজ যেটি নির্দেশ করে মানচিত্রের কোন স্থান থেকে ভেস্তিবিউলের প্রাচীন নিদর্শনগুলি আহরণ করা হয়েছে।
ডিসপ্লে কেসে মধ্যে রয়েছে নানা প্রকার সুন্দর ঐতিহাসিক নিদর্শন। মা ও সন্তানের যুগলবন্দী। সুসজ্জিত জলের পাত্র, রন্ধনের তৈজসপত্র যাতে সূর্য অঙ্কন করা, তিরের ফলা ও কুঠারের ফলা ইত্যাদি থেকে বোঝা যায় ইতিহাস কীভাবে ধীর পায়ে এগিয়েছে বর্তমানে।
গ্যালারিগুলি সময় অনুসারে সাজানো হয়েছে। তবে, অনেকসময়ই সৌন্দর্য ও শিল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেও সাজানো হয়েছে বইকি। যেমন একটি গ্যালারিতে চাইনিজ ড্রাগনের প্রাচীন মূর্তির সঙ্গে একযোগে অবস্থিত ভূমধ্যসাগরীয় স্ফিংসের মূর্তি। আবার অন্য এক গ্যালারিতে ১৪ শতকের ফরাসী চিত্র ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ডের সঙ্গে একইভাবে অবস্থান করছে মিশরিয় দেবী আইসিস ও তার পুত্র হোরাস-এর মূর্তি, যেটি খ্রিস্টজন্মের প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো।
আত্মিক অনুভূতি:
এরকম ভাবেই এক একটি গ্যালারি ঘুরতে ঘুরতে কখন সময় কেটে গেল টের পেলাম না। ওমর বেশ যত্ন নিয়ে আমাকে সমস্ত গ্যালারির অন্তর্নিহিত অর্থ ও ইতিহাস জানাচ্ছিল। বারো নম্বর গ্যালারি শেষ হয় চিত্রশিল্পী ওয়াইওয়াই-এর দুর্দান্ত একটি ইনস্টলেশান আর্ট দিয়ে। তারপর খুব সাধারণ আরেকটি দরজা দিয়ে আমি ও ওমর সংগ্রহশালা থেকে বেরিয়ে আসি।
একটা কথা স্পষ্ট, এই সংগ্রহশালায় প্রবেশ করলে মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। চারপাশে শিল্প সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এত অনুপম ভাস্কর্য যে যেকোনো বয়সের মানুষ চোখ ফেরাতে পারেন না। প্লাজার মধ্যে প্রথমেই চোখে পড়ে ফরাসী ভাস্কর অগাস্টে রোঁদির ‘দ্য ওয়াকিং ম্যান অন্য আ কলাম’ নামক ভস্কর্যটি। সেটির থেকে মুগ্ধ চোখ সরাতেই নজরে আসবে ইতালিয় ভাস্কর জিসেপ্পে পেনোনের ‘জার্মিনেশন’ নামক শিল্পকর্ম।
সমসাময়িক শিল্পী জেনি হোলজার আবার একদম অন্যরকম একটি শিল্পকর্ম উপহার দিয়েছেন আমাদের। তিনি সুমেরীয় লিপির সাহায্যে একটি ফ্রেস্কো ট্যাবলেট স্থাপন করেছেন। এই ফ্রেস্কোটি যেন আমাদের মনে করায় যে পৃথিবীর অনেক রহস্য এখনও আমাদের অজানা। প্রাচীন ভাষার গোড়ার কথা আদতে এখনও শেখা বাকি। মুগ্ধ বিস্ময়ে চুপ হয়ে যেতে হয় এই অনুভূতির সামনে।
বেরিয়ে আসার পর কফি খেতে খেতে ওমর আমাকে প্রশ্ন করে ঠিক কতটা ভাল লেগেছে আমার। উত্তর দিতে গিয়ে খেয়াল করি, এত অপূর্ব এক সংগ্রহশালা কতটা ভাল লেগেছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। ইতিহাস ও শিল্পর এত অপূর্ব মেলবন্ধন আমাকে বাক্যহীন করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই সংগ্রহশালা দেখতে আসা যেন আসলে নিজের রুহকে প্রশ্ন করা, আমি কী জানি? আমি ঠিক কতটা জানি?
ওমরকে এই কথা জানাতে সে শুধু মৃদু হেসে উত্তর দেয়, ‘ আমাদের এই সংগ্রহশালা আসলে প্রশ্নে শুরু। সাধারণ প্রশ্ন, কী দেখার আছে এইখানে। আবার প্রশ্নে শেষ, সে প্রশ্ন দার্শনিক প্রশ্ন, অস্তিত্বের প্রশ্ন।’