সন্তানকে ধর্মের পথ চেনাবেন কী করে?

ঈশ্বরবিশ্বাসী ধার্মিক সন্তান ইমানদার মুসলমান পরিবারে আল্লাহর রহমতস্বরূপ। কিন্তু সত্যি কি বাস্তবে এমন সন্তান হয়?
পিতা মাতার এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ, তাফসিরের পাতা উল্টোলেই এর উত্তর পাওয়া যাবে।
ঈশ্বরবিশ্বাসী ধার্মিক সন্তান অর্থাৎ যে সন্তানের ইসলাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিষ্কার ধারণা রয়েছে এবং যে নিজেকে আল্লাহর চরণে অর্পণ করেছে। সুরাত আল ইমরানে স্বয়ং আল্লাহ নিজে বলেছেন,
“কোন মানুষকে আল্লাহ কিতাব, হেকমত ও নবুওয়ত দান করার পর সে বলবে যে, ‘তোমরা আল্লাহকে পরিহার করে আমার বান্দা হয়ে যাও’-এটা সম্ভব নয়। বরং তারা বলবে, ‘তোমরা আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও, যেমন, তোমরা কিতাব শিখাতে এবং যেমন তোমরা নিজেরা ও পড়তে। “ [কুর-আন ৩:৭৯ ]
ধার্মিক মানুষ বলতে পণ্ডিত, স্কলার ও সাধকদেরও বলা হয়। সুরা আল মাইদাতে আল্লাহ বলেছেন, “দরবেশ ও আলেমরা কেন তাদেরকে পাপ কথা বলতে এবং হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করে না? তারা খুবই মন্দ কাজ করছে।“ [কুর-আন ৫:৬৩]
ধর্মপ্রাণ ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ তিনটি অভ্যাসের সমন্বয়ে হয়, সেগুলো হল ধর্ম, ধর্ম বিষয়ক জ্ঞান ও উপাসনা। এককথায় বলা যায় জ্ঞান ও সেই জ্ঞান দ্বারা জীবনযাপন করাই ধার্মিক মানুষের মূল উদ্দেশ্য।
ধর্মপ্রেমী মানুষের আল্লাহকে নিয়ে সম্যক জ্ঞান থাকে, আর সেই জ্ঞান সে জীবনে কাজে লাগায়।
কিন্তু একটি ধার্মিক মানুষের স্বভাব কি একটি শিশুর মধ্যে আসতে পারে?
পারে, যদি সেই শিশু আল্লাহর অভিশাপের ভয় পায়, ভালবেসে কুর-আন পড়ে, মসজিদে নমাজ পড়তে যায়। ধার্মিক জ্ঞানে যার আগ্রহ রয়েছে। বাবা মাকে সম্মান করে। রমজানে বুজুর্গদের সঙ্গে ইত্তিকাফে অংশ গ্রহণ করে। আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখে তাহলেই সেই শিশুকে ধার্মিক বলা চলে।
হয়তো বর্তমান শিশুদের মন বেশিরভাগটাই ভিডিয়োগেম, মোবাইল ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ের দিকে বেশি থাকে। কিন্তু তাও, সঠিকভাবে শিক্ষা প্রদান করে আমরা আমাদের শিশুদের ইমানদার ও ধার্মিক বানিয়ে তুলতে পারি।
আল্লাহর উপর অটুট বিশ্বাসঃ
একটা সুন্দর গল্পের মাধ্যমে এটি বোঝানো যায়, একবার এক ইমানদার মুসলমান মসজিদে ঢুকে দেখলেন একটি এগারো বছরের ছেলে নমাজ পড়ছে। সেই ব্যক্তি ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কে? তোমার পিতা কে?
ছেলেটি উত্তর দেয়, আমি অনাথ।
ঐ ব্যক্তি তখন ছেলেটিতে দত্তক নিতে চায়। ছেলেটি তিনটে প্রশ্ন করে,
‘আমার যখন খিদে পাবে আমাকে আপনি খাদ্য দেবেন?’
‘আমার যখন তৃষ্ণা পাবে আপনি আমাকে জল দেবেন?’
‘আমার মৃত্যুর পর আমাকে জীবনদান করতে পারবেন?’
ওই ব্যক্তি প্রথম দুটি কথার হ্যাঁ বাচক উত্তর দিলেও শেষ প্রশ্নে অবাক হয়ে যান। তিনি জিজ্ঞাসা করেন এ কী করে সম্ভব?
ছেলেটি তখন বলে, তাহলে আমাকে আমার আসল বাবার কাছে থাকতে দিন। তিনি আল্লাহ। তিনিই আমার সব।
যে শিশু এভাবে ভাবতে পারবে, বা আপনার শিশুকে যদি আপনি এভাবে ভাবাতে পারেন তাহলেই সে হয়ে উঠবে ধার্মিক।
পিতা ও পুত্রের গল্পঃ
শোনা যায়, আবু ইয়াজিদ তৈফুর ইবন ইসা আল বিস্তামি (রহঃ) যখন প্রথম আল্লাহর বাণী, ‘হে বস্ত্রাবৃত!রাত্রিতে দন্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে, অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম। [কুর-আন ৭৩:১-২] শোনেন তখন তিনি তাঁর পিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে পিতা, আল্লাহ সর্বশক্তিমান কাকে এই কথাটা বলছেন?
তাঁর পিতা তাকে উত্তর দিয়েছিলেন, “ আল্লাহ সর্বশক্তিমান তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলায়হি ওয়াহ সালামকে এই নির্দেশ দিচ্ছেন।“
পুত্র তখন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পিতা, আপনি কেন নবীর মতো পালন করেন না?’
পিতা বলেছিলেন ,’আল্লাহর কৃপা বর্ষিত হয়েছিল বলেই নবী এই নির্দেশ পালন করতে পেরেছিলেন।‘
এতে পুত্র মৌনভাব অবলম্বন করেছিলেন।
অতঃপর,
‘আপনার পালনকর্তা জানেন, আপনি এবাদতের জন্যে দন্ডায়মান হন রাত্রির প্রায় দু’তৃতীয়াংশ, অর্ধাংশ ও তৃতীয়াংশ এবং আপনার সঙ্গীদের একটি দলও দন্ডায়মান হয়। আল্লাহ দিবা ও রাত্রি পরিমাপ করেন। তিনি জানেন, তোমরা এর পূর্ণ হিসাব রাখতে পার না। অতএব তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমা পরায়ন হয়েছেন। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর। তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে–বিদেশে যাবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জেহাদে লিপ্ত হবে। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ ততটুকু আবৃত্তি কর। তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্যে যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে। তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।‘ [কুর-আন ৭৩:২০ ]
কুর-আনের এই বাণী পড়ার পর পুত্র আবার পিতাকে জিজ্ঞাসা করে যে , ‘হে পিতা, আমি জানতে পারলাম নবীর সঙ্গে আরও কিছু মানুষ রাতে উপাসনা করতেন। তারা তবে কারা?’
পিতা উত্তর করেন, ‘তারাও আল্লাহর প্রিয় অনুচর।‘
পুত্র তখন জিজ্ঞাসা করে, ‘তাহলে আপনি সেই প্রিয় অনুচরের মধ্যে থাকবেন না?’
পিতা বলেন, “হে পুত্র, তুমি সঠিক, আমিও রাতে উপাসনা করব এবার থেকে।‘
এরপর থেকে আবু ইয়াজিদের পিতা রাতে উপাসনা শুরু করেন। একরাতে আবু ইয়াজিদ পিতার সঙ্গে উপাসনা করতে চাইলে পিতা তাকে নিষেধ করেন।
কিন্তু পুত্র বলে, হে পিতা, কেয়ামতের দিন আল্লাহকে তাহলে কী জিকির করব?
অতঃপর পিতা তাকে উপাসনা করতে অনুমতি দেন।
আপনার সন্তানের মধ্যে এই মানসিকতা থাকলেই সে ধার্মিক।
ধার্মিক কন্যার গল্পঃ
শায়েখ হাতিম আল আসাম (রাহি.) একদিন তাঁর সন্তানদের জানান যে তিনি হজ করতে যাবেন। সন্তানরা ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘তবে আমাদের দায়িত্ব কে নেবে পিতা?’
এতে শায়েখ হাতিম কন্যা বাকিদের কান্না থামাতে বলে কারণ আল্লাহই আসলে ইমানদার মুসলমানদের দায়িত্ব নেন।
আল্লাহ তা’আলাই তো জীবিকাদাতা শক্তির আধার, পরাক্রান্ত। [কুর-আন ৫১:৫৮ ]
হাতিম হজে চলে যাওয়ার পর একদিন গৃহে চূড়ান্ত খাদ্যাভাব দেখা দেয়। শিশু সন্তানরা কাঁদতে শুরু করে খিদেয় জ্বালায়। বড় বোনকে দূষতে থাকে এই অবস্থার জন্য। মেয়েটি তাদের কথার জবাব না দিয়ে ভেতরের কক্ষে গিয়ে দু’হাত মুনাযাতে উঠিয়ে বলতে লাগলো, আল্লাহ ! আপনার ওয়াদা তো সত্য ।
এমন অবস্থায় সেই শহরের শাসক সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি অত্যন্ত পিপাসার্ত ছিলেন। তার অনুগতরা নিকটস্থ হাতিম আল আসামের বাড়ি থেকে পানি চাইতে যান। হাতিম কন্যা তাদের পানি দেয়। পানি পান করে শাসক জিজ্ঞাসা করেন, এটা কার বাড়ি?
হাতিম আল আসামের বাড়ি শুনে তিনি বাড়ির মূল ফটকে একটি সোনার মুদ্রা রাখেন ও বাকিদেরও রাখতে বলেন।
অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা দেখে হাতিম কন্যার চোখে জল আসে। তাই দেখে তাঁর মা জিজ্ঞাসা করেন, ‘কন্যা, তোমার চোখে জল কেন?’
কন্যা উত্তর দেন, ‘সামান্য এক মানুষের করুণা আমাদের উপর এভাবে বর্ষিত হচ্ছে, তাহলে আল্লাহর করুণা রহমত হওয়ার জন্য আমাদের কতটা কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ?’
আপনার কন্যা যদি এমন ভাবে, তবেই সে ধার্মিক।
ঈশ্বরবিশ্বাস প্রতি মানুষের মধ্যে রয়েছে। শুধু খুঁজে নিয়ে পালন করতে হবে।