সপ্তাহান্তে পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিন ইয়াখনি পোলাওয়ের মজা

পোলাও জাতীয় কোনও পদ বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় ‘বিরিয়ানির’ কথা। মাংস দিয়ে প্রস্তুত পোলাও এবং বিরিয়ানির মধ্যে পার্থক্য কোথাও এই বিষয়ে বিস্তৃত তর্ক রয়েছে। প্রথমেই বলা যাক বিরিয়ানির কথা। ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ এবং মায়ানমার প্রদেশে বিরিয়ানি বিশেষভাবে জনপ্রিয়। সাধারণত ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল এবং তাঁদের অধীনে কর্মরত মুসলমান বাবুর্চিদের হাত ধরে এই পদটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিরিয়ানি শব্দটিরও উৎপত্তি কিন্তু ফারসি শব্দ ‘বিরিঞ্জ’ থেকে যার অর্থ হল ভাত। অন্য আরেক দল ভাষাবিদদের মতে ফারসি শব্দ ‘বিরিয়ান’ থেকে এই শব্দের উৎপত্তি। অর্থ হল রোস্ট করা। অর্থের সঙ্গে বিষয়ের সাযুজ্য ভুল নয় কারণ বিরিয়ানি প্রস্তুতির সময়ে কিন্তু মাংস, ভাত, ক্ষেত্রবিশেষে ঘি বা ডালনা বা তেল সহযোগে একধরনের রোস্ট প্রক্রিয়া চলে। বিরিয়ানি তৈরির প্রণালী মোটেও এতটা সহজ নয়।
পোলাও আর বিরিয়ানির পার্থক্য
এবার আসা যাক পোলাও-এর প্রসঙ্গে। পোলাও পদটি বলকান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন প্রদেশে বেশ জনপ্রিয়। অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশেও এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। পোলাও-তেও বিভিন্ন রকমের উপকরণের সঙ্গে ভাতকে ভাজা হয়ে থাকে। বাইরে থেকে দেখতে বিরিয়ানি এবং পোলাও-এর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য হয়তো চোখে পড়বে না। তবে পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। প্রথমত রান্নার উপকরণ এবং প্রণালীতে।
বিরিয়ানি প্রস্তুতির সময়ে তিনটি হাঁড়ি ব্যবহার করা হয়, তাই একে তেহারিও বলা হয়ে থাকে। পোলাও বানানোর ক্ষেত্রে চাল আগে থেকে সেদ্ধ করে রাখা হয় কিন্তু বিরিয়ানির ক্ষেত্রে চাল ধোয়ার পরে তাতে গরম জল যোগ করা হয়, এতে চালের যে আসল সুঘ্রাণ তা অনেকটাই বজায় থাকে। বিরিয়ানি তৈরির সময়ে মাংস বা গোস্ত একটি অন্যতম প্রধান উপকরণ এবং পোলাও-র ক্ষেত্রে এমনটা নাও হতে পারে। আর একটি পার্থক্য হল মশলার পার্থক্য। বিরিয়ানি তৈরিতে অনেক বেশি পরিমাণে মশলা ব্যবহার করা হয়, যেখানে পোলাও ব্যবহারে অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে মশলা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
পোলাও-তে গোস্ত বা মাংসের ব্যবহার ঐচ্ছিক, একথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু আজকে আমরা বলব ‘ইয়াখনি পোলাও’-র কথা। খাদ্যরসিক মানুষেরা এবং বিরিয়ানি প্রেমী মানুষদের এই পোলাও রীতিমতো চমকে দেবে, কখনও কখনও দুইয়ের মধ্যে কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দটা ঠাহর করতেও রীতিমতো দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে হতে পারে।
কোথা থেকে এল ইয়াখনি পোলাওয়ের মজা
ইয়াখনি পোলাও হল পাকিস্তানের একটি প্রসিদ্ধ আমিষ রেসিপি। কাশ্মীর অঞ্চলে যারা গিয়েছেন তারা হয়তো এই পোলাও চেখে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। ইয়াখনি পোলাও মধ্যপ্রাচ্যে উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয় এবং বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন প্রদেশে এই ইয়াখনি পোলাও বানানোর প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি আলাদা হয়ে থাকে। পার্সিয়ান শব্দ ‘ইয়াকনি’ বা ‘Yakhni’ থেকে এই শব্দটির ব্যুৎপত্তি হয়েছে। অর্থ হল মাংসের যে ঝোল বা যাকে আমরা স্টক বা স্টু।
প্রকৃত ইয়াখনি তৈরিতে দই হল অতি অবশ্য একটি উপকরণ। এছাড়া মৌরি, মরিচ, জাফরান, শুকনো আদা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ প্রভৃতি বিভিন্ন মশলা দিয়ে একধরনের সুস্বাদু মাংসের ব্রোথ তৈরি করা হয়। জাফরান থাকে বলে একধরনের আলাদা গন্ধ মিশে যাকে এই ইয়াখনি পোলাও-র মধ্যে। যেহেতু আফগান সংস্কৃতির সঙ্গে এই ইয়াখনি পোলাও-র এক বিশেষ সংযোগ রয়েছে, সুতরাং ভারতবর্ষে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে মূলত মোঘলদের হাত ধরেই এই পদটির জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে এমনটা আমরা বলতে পারি।
ইয়াখনি পোলাও-র উদ্ভবের প্রসঙ্গে আরও একটা মজার কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। একসময়ে এক আফগান রাজা তার সেনাপারিষদের নিয়ে তাঁর সাম্রাজ্যের যে অঞ্চলে সেনাছাউনি বা ব্যারাক রয়েছে তা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেই বিষয়ে নানা জিনিস পরিদর্শন করতে করতে তিনি লক্ষ্য করলেন সৈন্যবাহিনিতে যে সকল খাবার সরবরাহ করা হয় তাঁর গুণগত এবং পুষ্টিগত মান খুব একটা উন্নত নয়। সেই সময়ে তিনি বাবুর্চিকে ডেকে বিরিয়ানির বিকল্প কোনও পদ রান্নার নির্দেশ দিলেন এবং এই ঘটনা থেকেই ‘ইয়াখনি পোলাও’-র সূচনা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
ইয়াখনি পোলাও নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পরে বাড়িতে কীভাবে সুস্বাদু ইয়াখনি পোলাও তৈরি করা যেতে পারে, তা একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে।
ইয়াখনি পোলাও তৈরির প্রণালী-
উপকরণ- ইয়াখনি বানানোর জন্য- ৫০০ গ্রাম মাংস (ভাল করে মাংস ধুয়ে নিতে হবে), ৪ কাপ পানি ,স্বাদমতো নুন, মাঝারি মাপের পেঁয়াজ ২টি (বড় টুকরো করে কাটা), ৪-৫ টি রসুন কোয়া, ৩-৪টি আদা (এক্ষেত্রে আদা বাটার বদলে আদাকে ভাল করে কুচি করে নেবেন), ৩-৫ গোটা কাঁচালঙ্কা, ২ টেবিল চামচ গোটা ধনে, ২ টেবিল চামচ গোটা মৌরি, ১ চা চামচ শাহী জিরা, ৩টি ছোট এলাচ (আপনি চাইলে একটা-দুটা বড় এলাচও দিতে পারেন), ৪-৫টি লবঙ্গ, ১টি দারুচিনি, পরিমাপ এবং প্রয়োজন অনুসারে জায়ফল ও জয়ত্রী, 1টি স্টার অ্যানিস, ৭-৮টি গোটা গোলমরিচ।
পোলাও এর জন্য -২ কাপ বাসমতী চাল, ২ টেবিল চামচ তেল, ১ টেবিল চামচ ঘি, ১-২ টেবিল চামচ ঘি, ৩-৪ টেবিল চামচ ভাজা পেঁয়াজ (পেঁয়াজের টুকরোগুলো আগে থেকে ভাল করে কেটে রাখবেন), ২-৪ টি এলাচ, ১টি দারুচিনি, ৩-৪ টি লবঙ্গ, ২ চা চামচ আদা রসুন বাটা, ১/২ কাপ টক দই, স্বাদমতো লবণ, প্রয়োজনমতো কাঁচালঙ্কা, গোলাপ জল (ইচ্ছানুসারে), ২ টেবিল চামচ কেশর মেশানো দুধ, ১ চা চামচ ঘি (একদম শেষে উপর থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে)।
প্রণালী
প্রথমে একটি কাপে দুধ গরম করে নিন এবং তাতে কেশর ভিজিয়ে রাখুন। এবার একটি প্রেসার কুকারে মাংস, পেঁয়াজ, আদা রসুন কাঁচা লঙ্কা আর জল একসঙ্গে দিয়ে দিন। এরসঙ্গে লবণ দিতে হবে। এবার কুকারের ঢাকনা বন্ধ করে মিনিট পনেরো কুড়ি রান্না করতে হবে। সিটি প্রয়োজন নেই। তবে মাংস ঠিক মতো তৈরির জন্য সিটি দিতে পারেন। এবার কুকারের ঢাকনা খুলে মাংস গুলিকে সাবধানে আলাদা করে বার করে নিন। আর জলটি ছাঁকনির সাহায্যে ছেঁকে আলাদা রাখতে হবে। ফেলে দেবেন না। এবার একটি পাত্র নিন। যে পাত্রে পোলাও রান্না করা হবে। সেই পাত্রে ঘি আর তেল গরম করে পেঁয়াজ ভেজে নিন।
একইসঙ্গে আদা রসুন দিয়ে একটু ভেজে নিতে হবে। একটু বেশি সময় ধরে পুরো বিষয়টা কষানোর চেষ্টা করুন। সবকিছু একটু কষানো হয়ে গেলে মাংস দিয়ে বেশ ভালো করে কিছুক্ষণ নাড়তে হবে। এবার দই দিয়ে সবকিছু ভাল করে মিশিয়ে নিন। এবার চাল দিয়ে ২-৩ মিনিট ভাল করে নাড়তে হবে। এবার আগে থেকে ছেঁকে রাখা ‘ইয়াখনি’ দিতে হবে ।
যদি দুই কাপ ইয়াখনি থাকে তাহলে দুইকাপ পানি দিতে হবে। আর চাল আর পানির অনুপাত হবে ১:২। এবার জল ফুটে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জল ফুটে যখন একটু কমে আসবে তখন কেশর গোলা দুধ, কাঁচা লঙ্কা, গোলাপজল আর ঘি দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে রাখতে হবে। দম দিতে হবে ১০ মিনিট মতো। ১০ মিনিট পরে গ্যাস থেকে নামিয়ে নিন কিন্তু ঢাকনা খুলবেন না। ১০ মিনিট ঢাকনা বন্ধ অবস্থায় রাখতে হবে। এইভাবেই তৈরি হয়ে যাবে ইয়াখনি পোলাও, তারপর ভাজা পেঁয়াজ কাঁচা পেঁয়াজ আর শসা দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে।