সমাজ ও ইসলামে বিশেষ ভাবে সক্ষমদের স্থান কোথায়?

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সমাজ সেই মানুষেরই একটা অংশ বিশেষ ভাবে সক্ষম। সমাজ তাদের প্রতিবন্ধী আখ্যা দিলেও সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । একবার নয়, বার বার। যেমন মাসুদুর রহমান বৈদ্য।
সমাজ ও ইসলামে বিশেষ সক্ষম মাসুদুরের কীর্তিঃ
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বল্লভপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা স্থানীয় মসজিদের ইমাম ছিলেন। দশ বছর বয়সে রেল দুর্ঘটনায় হাটুর নীচ থেকে মাসুদুরের দুটি পা কাটা পড়ে। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মহারাষ্ট্রের পুণে শহরে আর্টিফিসিয়াল লিম্ব সেণ্টার দ্বারা আয়োজিত সতেরোটি সাঁতার প্রতিযোগিতার মধ্যে ষোলটিতে মাসুদুর প্রথম হন। এরপর তিনি গঙ্গার বুকে পাণিহাটি থেকে আহিরিটোলা পর্য্যন্ত সাঁতার কেটে পঞ্চম ও মুর্শিদাবাদ জেলায় একাশি কিলোমিটার দীর্ঘ সাঁতার প্রতিযোগিতায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এশিয়ার প্রথম প্রতিবন্ধী সাঁতারু হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশ্বের প্রথম প্রতিবন্ধী সাঁতারু হিসেবে জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করেন। এই প্রণালী পার করতে গিয়ে তিনি স্পেনের তারিফা দ্বীপ থেকে মরক্কোর উপকূল পর্য্যন্ত বাইশ কিলোমিটার চার ঘণ্টা কুড়ি মিনিট সময় নেন।
২০১৫ সালে মারা যান মাসুদুর। কিন্তু তাঁর কীর্তি, অদম্য জেদ সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসে। প্রতিবন্ধীদের কোণঠাসা না করে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা বাড়িয়ে দেওয়াই আমাদের কর্তব্য। কারণ প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতা পরকালে মুক্তির উসিলা। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তাদেরও ন্যায্যপ্রাপ্য। তাই প্রতিবন্ধীদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা প্রদর্শন ও সহানুভূতিশীল হওয়া অত্যাবশ্যক। যেমননি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ (প্রতিবন্ধী) ব্যক্তির খোঁজখবর নাও এবং বন্দীকে মুক্ত করে দাও।’ –সহিহ বোখারি
সমাজের উচিৎ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াঃ
সমাজ ও ইসলামে প্রতিবন্ধীদের ভালোভাবে বাঁচার অধিকার আছে, তারাও মানুষ। মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সর্বজনস্বীকৃত বিশ্বজনীন ধর্ম ইসলাম। প্রতিবন্ধীরা যেহেতু মানবজাতির অংশ তাই সুস্পষ্টভাবেই এ কথা ভাবা যায়, ইসলাম তাদের ব্যাপারে অবশ্যই বিশেষ ব্যবস্থাপনার কথা বলবে এবং তা বিশেষভাবে পালনের তাগিদ প্রদান করবে। একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, সামাজিক জীবনে সাধারণ ব্যক্তিরা যেসব অধিকারের যোগ্য সমাজের অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধীরাও একই অধিকার পাওয়ার যোগ্য। মানবতার ধর্ম ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে সদাচরণ, সাহায্য-সহযোগিতা এবং অন্যদের ওপর তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বিপদ-আপদে সব সময় তাদের পাশে দাঁড়ানো ইমানি দায়িত্ব। প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে অসদাচরণ, উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা ঠাট্টা-তামাশা করা সৃষ্টিকে তথা মহান আল্লাহতায়ালাকে উপহাস করার শামিল।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সমাজের সব শ্রেণীর মানুষকে সমান চোখে দেখতেন। মৃদু বাকপ্রতিবন্ধী সাহাবি হজরত বেলালকে (রা.) মসজিদে নববীর প্রথম মোয়াজ্জিন নিয়োগ দিয়েছিলেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে (রা.) নবী করিম (সা.) দু’দু’বার মদিনার অস্থায়ী শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এমনকি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখনই তাকে (আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম) দেখতেন, তখনই বলতেন, ‘স্বাগতম জানাই তাকে, যার সম্পর্কে আমার আল্লাহ আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন।’
অবহেলা নয়, সমাজের ভালবাসাঃ
প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে সবাইকে খুবই সতর্ক হতে হবে। তাদের প্রতি অবহেলা নয়, ভালোবাসা আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক পুনর্বাসনের জন্য সামর্থ্যবান সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবন্ধীর মানসম্মান সংরক্ষণ, মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার প্রদান এবং তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। তারা যাতে অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার না হয় এবং সমাজ ও পরিবেশে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবন যাপন করার অধিকার পায়, সেই ব্যবস্থা করতে বলেছে ইসলাম। শুধু প্রতিবন্ধী নয়, যেকোনো ধরনের অসুস্থ ও অক্ষম ব্যক্তির প্রতি মানবিক ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ভালো-মন্দেরও সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকুলের কিছু অংশকে আমরা অনেক সময় অস্বাভাবিক ও অসুস্থ দেখতে পাই। এর রহস্য ও কল্যাণ আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। তবে কেউ কেউ আল্লাহর রহস্য ও কল্যাণের কথা না বুঝেই স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে দোষ দেয়; অথচ তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র ও দোষমুক্ত। আবার অনেকে সৃষ্টিকেই দোষারোপ করে। যার কোনোটাই উচিত নয়।
আল্লাহর সৃষ্টির কারণঃ
সৃষ্টিজগতের একাংশকে ত্রুটিপূর্ণ বা অপূর্ণাঙ্গ করার রহস্য আল্লাহই ভালো জানেন। তবে বিজ্ঞজনেরা এর পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। তা হলো—
বান্দা যেন আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং বুঝতে পারে যে তিনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমন তিনি এর ব্যতিক্রমও করতে সক্ষম।
আল্লাহ যাকে পূর্ণতা দান করেছেন সে যেন নিজের প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পাকে স্মরণ করে, অতঃপর তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারণ আল্লাহ চাইলে তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু করতে পারতেন।
প্রতিবন্ধীকে আল্লাহ তাআলা এই বিপদের বিনিময়ে তাঁর সন্তুষ্টি, দয়া, ক্ষমা ও জান্নাত দিতে চান। নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি যার দুই প্রিয়কে (দুই চোখ) নিয়ে নিই, অতঃপর সে ধৈর্য ধরে এবং নেকির আশা করে, তাহলে আমি তার জন্য এর বিনিময়ে জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হই না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪০১)
নবী (সা.) নিজেও অক্ষম ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি সম্মান ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করতেন।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক নারীর বুদ্ধিতে কিছু ত্রুটি ছিল। সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার সঙ্গে আমার প্রয়োজন আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে অমুকের মা, তুমি কোনো রাস্তা দেখে নাও, আমি তোমার কাজ করে দেব। তারপর তিনি কোনো পথের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করলে সে তার কাজ সেরে নিল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩২৬)
ইসলাম প্রতিবন্ধী, অক্ষম ও দুর্বল ব্যক্তিদের অনেক কঠিন কাজ সহজ করে দিয়েছে এবং তাদের থেকে কষ্ট দূর করার বিধান দিয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে—ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হয় এবং পাগল যতক্ষণ না সে জ্ঞান ফিরে পায় বা সুস্থ হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪১)
উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকও প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনার জন্য বিশেষ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ৮৮ হিজরি মোতাবেক ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষাকেন্দ্রে ডাক্তার ও সেবক নিয়োগ করেন। প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত ভাতা প্রদান করেন। সব অক্ষম, পঙ্গু ও অন্ধের জন্য খাদেম নিযুক্ত করেন।
এখন আমাদের দায়িত্ব হলো, নিজের সুস্থতার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং প্রতিবন্ধী ভাইদের জন্য দোয়া করা। ইসলাম তাদের যেসব অধিকার দিয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। যথাসম্ভব প্রতিবন্ধীদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। সমাজের কিছু লোক তাদের দেখাশোনা করলে বাকিরা গুনাহগার হবে না।