সম্প্রতি শিরোনামে উঠে আসা বুলগেরিয়ার মুসলিমরা নিজেদের অধিকার দাবি করছে

উসমানীয় শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া প্রথম মুসলিম সম্প্রদায় হল বুলগেরিয়ার মুসলিমরা। ১৮৭৮ সালে উসমানীরা চলে যাওয়ার পর বুলগেরিয়ার সংখ্যালঘু তুর্কী মুসলমানদের রক্ষা করতে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বহু বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করেও মুসলিম সংখ্যালঘুরা ১৩০ বছর ধরে তাঁদের মুসলিম পরিচয় বজায় রেখেছিল। এই কঠিন সময়ে পড়াশোনা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তুর্কী মুসলমানেরা ইসলামের প্রতি নিজেদের আনুগত্য বজায় রেখেছিলেন।
তুর্কী, পোমাক এবং রোমানি মুসলিম, যাঁরা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় হারিয়েছিল তাঁরা শীঘ্রই বুলগেরিয়ান নামের একটা গোষ্ঠীর অধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। ইউরোপের সব থেকে বড় মুসলিম জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও বুলগেরিয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠীর সবথেকে বড় দুটি সমস্যা হল, সংখ্যালঘু মর্যাদায় বাধা দান এবং পশ্চিমী সাহায্যপ্রাপ্ত মিশনারি সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে পোমাক এবং রোমানিদের একত্রিত করা। এই আশঙ্কা থেকে বেরিয়ে আসার সবথেকে উপযুক্ত রাস্তা হল ইসলামিক কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করা। প্রধান মুফতি অফিসের এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বুলগেরিয়ার ধর্মীয় মুসলিম সংগঠনগুলির সংক্ষিপ্ত তথ্য
বুলগেরিয়ায় মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ এবং প্রশাসকরা হলেন নির্বাচিত প্রতিনিধি। এখানে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর জাতীয় ইসলামিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রধান মুফতি গোটা সম্প্রদায়ের সভাপতিত্ব করেন এবং অন্যান্য ইসলামিক কাউন্সিলের সভাপতিরা কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে যোগদান করেন।
বর্তমানে বুলগেরিয়ায় ১৬ জন আঞ্চলিক মুফতি আছেন, যাঁরা উচ্চ ইসলামিক পরিষদ দ্বারা নিযুক্ত। এঁরা সাধারথত এক-একটি প্রদেশের দায়িত্বে থাকেন, তবে কোনও এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যা কম হলে একাধিক প্রদেশেরও দায়িত্ব সামলান।
প্রধান মুফতির দপ্তর ধর্মীয় বিষয়গুলি দেখে এবং বুলগেরিয়ার প্রশাসন ও অন্যান্য সংগঠনের কাছে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আঞ্চলিক মুফতিরা স্থানীয় প্রশাসন স্তরের বিষয়গুলিও দেখেন।
২৫ জন সদস্যবিশিষ্ট প্রধান মুফতির দপ্তরটি রয়েছে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায়। তার পাশাপাশি তাদের শিক্ষা, পথনির্দেশ, প্রকাশনা ও হিসেব রক্ষণ ইত্যাদি দপ্তরও এই শহরেই আছে। তবে আঞ্চলিক মুফতির দপ্তরে দুই থেকে পাঁচ জন লোক থাকে।
প্রধান মুফতির দপ্তর আঞ্চলিক মুফতি অফিসের মাধ্যমে মুসলিম সংগঠনগুলির আওতায় থাকা জমি এবং সম্পত্তির দেখাশোনা করে। এবং রাষ্ট্র বেআইনি ভাবে কোনও ব্যক্তি বা কোনও সংগঠনের সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছে কি না, সেই দিকে নজর রাখার জন্য বিভিন্ন আদালতের কার্যাবলিতে নজর রাখে।
প্রধান মুফতির দপ্তর ইসলামিক পড়াশোনার পাঠক্রম তৈরির সাথে বই এবং প্রশিক্ষক পাঠানো, মুফতি এবং ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ৫০০টি গ্রাম ও শহরে বাচ্চাদের কুরআন শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে।
এই দপ্তর থেকে পাক্ষিক পত্রিকা “মুসলিমস” প্রকাশিত হয় বুলগেরিয়ান এবং তুর্কী ভাষায়, সাথে ইসলামিক বই এবং লিফলেটও প্রকাশিত হয়।
বুলগেরিয়ার ১২০০-এর অধিক মসজিদের প্রায় ৯৫০ জন ইমামকে আঞ্চলিক মুফতি দপ্তর থেকে নিয়োগ করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে মাত্র ১৫০ জন ইমামকে প্রধান মুফতির দপ্তর থেকে বেতন দেওয়া হয়। বাকিরা স্থানীয় জামাত থেকে বেতন পান, বা কখনও পান না। যাঁরা কোনও বেতন ছাড়াই কাজ করছেন তাঁরা ধর্মীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। প্রধান মুফতির দপ্তর থেকে ৮ জন ধর্ম প্রচারককে মূলত ধর্ম প্রচার এবং পথ প্রদর্শনের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে।
প্রধান মুফতি এবং আঞ্চলিক দপ্তর থাকা সত্ত্বেও বুলগেরিয়ার মুসলিমদের বহু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, যেমন –
আইনী সমস্যা
নির্বাচিত প্রধান মুফতিকে সোফিয়া মিউনিসিপ্যাল আদালতে গিয়ে নিজেকে নথিভুক্ত করতে হয়, যাতে অনেকটাই সময় লেগে যায়। এর ফলে প্রধান মুফতি অফিসের ক্রিয়াকলাপ দীর্ঘায়িত হয়, অথচ বুলগেরিয়ার সনাতন চার্চকে এটা করতে হয় না।
আর্থিক সমস্যা
মুসলিম সংস্থার থেকে বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তিগুলি ১৫ বছর পরেও ফেরত দেওয়া হয়নি, যেগুলো প্রধান মুফতি অফিসে মূলত প্রধান রাজস্ব এনে দিত। সরকারি বাজেটে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ হওয়া আর্থিক অনুদানও সঠিক অনুপাতে বণ্টন করা হয় না।
রাজনৈতিক সমস্যা
বুলগেরিয়ার কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো প্রধান মুফতির নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে থাকে। ১৯৯৫ সালে এমনই একজন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে উপেক্ষা করে তৎকালীন সোশ্যালিস্ট সরকার প্রাক্তন পুলিশ চিফকে প্রধান মুফতি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। এই বিষয়ে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য মানবাধিকার কমিশনের আন্তর্জাতিক কোর্টের শরণাপন্ন হলে শেষ পর্যন্ত বুলগেরিয়ার সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছিল।
বুলগেরিয়ার ধার্মিক মুসলিমরা সাধারণত সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন এবং রাজনীতির ব্যাপারে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করে থাকেন। তবে এই দেশে মূলত বুলগেরিয়ান তুর্কী এবং মুসলিমদের প্রতিনিধিরা মুভমেন্ট ফর রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস (এমআরএফ) গঠন করেছেন। বুলগেরিয়ার মুসলিম রাজনৈতিকরা নিজেদের ধর্মীয় গতিবিধি থেকে দূরে রাখলেও, এমআরএফ-কে একটি ইসলামিক দল হিসেবে গণ্য করা হয়। গত তিন চার বছর ধরে এম আর এফ আইনপ্রনেতারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন যা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে খুশি করেছে, এবং তাঁরা সম্প্রতি মুসলিমদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য রমজান মাসে ইফতারের জন্য দান করার পাশাপাশি মসজিদ নির্মাণেও অর্থ দান করেন।