সালাতে খুশু বা একাগ্রতা অর্জনের উপায়

আপনি যে কর্মেই ব্যস্ত থাকুন না কেন, আল্লাহ একটি সয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া সর্বদা আমাদের মাঝে চালু রেখেছেন, এমন একটি স্বর্গীয় প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে যেকোনো ব্যক্তি যেখানেই থাকুক না কেন সবসময়ই আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকতে পারবে। কিভাবে এটি সম্ভব? হ্যাঁ অবশ্যই সম্ভব আর তা হল সালাত আদায়ের মাধ্যমে। তবে আপনি যেন সালাত আদায় করেই আবার এটা ভাবতে শুরু করে দিয়েন না যে, আল্লাহর সাথে আপনার সম্পর্ক স্থাপন হয়ে গেছে। আপনার সালাতের মাঝে অবশ্যই এমন একটি বিশেষ গোপন উপাদান থাকতে হবে, যা আপনাকে আল্লাহর সাথে সংযুক্ত রাখবে। যদি সেই মূল্যবান জিনিস অনুপস্থিত থাকে, তাহলে আপনার সালাত হয়ে পড়বে অন্তঃসারশূন্য একটি ব্যাপার।
আপনি হয়ত সালাত আদায়ের জন্য দাঁড়াচ্ছেন কিন্তু সেখানে একটি ফাঁক থেকে যাচ্ছে। তাহলে মূল্যবান সেই গোপন জিনিসটি কি?
খুশু বজায় রেখে সালাত আদায়কারীরা সফল
আল্লাহ বলেন,
”(ঐ সকল) মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের সালাতে খুশু রক্ষা করে।” (আল কুরআন-২৩: ১-২)
অর্থাৎ, মূল্যবান সেই গোপন জিনিসটি হল খুশু। সালাতে বিনম্রতা, একাগ্রতা, আল্লাহর আনুগত্য, অখন্ড মনোযোগ ইত্যাদি সবকিছুই হচ্ছে খুশুর অন্তর্ভুক্ত।
খুশু তথা সালাতের মধ্যে গভীরভাবে মনোনিবেশ করা সালাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মূলত সালাতের মধ্যে সালাত আদায়কারীর পূর্ণ মাত্রায় প্রবেশ করার অবস্থাটিই হল খুশু।
অনেক সময় আমরা বেখেয়ালীভাবে অন্যান্য কাজ বা অভ্যাসের মত একটি কাজ বা অভ্যাস হিসেবে সালাত আদায় করে থাকি। কিন্তু আমাদের সালাতের মর্মার্থকে প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করা উচিত এবং সালাতের মধ্যে আল্লাহর সামনে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে উপস্থাপন এবং সেই সাথে সালাতের মধ্যকার কথোপকথনকে উপভোগ করা উচিত। এটা আমাদের জন্য কত সৌভাগ্যের বিষয় যে, সালাতের মাধ্যমে আমরা মূলত আল্লাহর সাথে কথোপকথন করে থাকি!
খুশু সালাত আদায়কারীকে সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করে।
খুশু অর্জনের উপায়
নিম্নে সালাতে খুশু অর্জনের জন্য সহায়ক কিছু উপায় সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ
১) সালাতে কি পাঠ করছেন সেদিকে মনোযোগ দিন
সালাতের মধ্যে কুরআন তেলাওয়াতের সময় লক্ষ্য রাখুন যে, আপনি কি পাঠ করছেন। পাশাপাশি আপনার তেলাওয়াতকৃত অংশটুকুর অর্থ বোঝারও চেষ্টা করুন। কুরআনে আমাদের জন্য পাঠানো নির্দেশনা সম্পর্কে আমাদের যথাযথ জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অর্থ বোঝার মাধ্যমে আমরা এই জ্ঞান অর্জন করতে পারি।
২) সুরা ফাতিহার মর্ম নিয়ে চিন্তা করুন
সূরা ফাতিহা সঠিকভাবে তেলওয়াত করুন। যদি আমরা সালাতের মধ্যে যথাযথভাবে সূরা ফাতিহা তেলওয়াত করতে এবং এই সম্পর্কে চিন্তা করতে পারি, তবে এটি আমাদের সামনে সালাতের সারমর্মকে পূর্ণভাবে তুলে ধরে।
আমাদের প্রয়োজন সর্বোচ্চ সচেতনতা, আন্তরিকতা ও মনোযোগী থাকা যখন আমরা সালাতের মধ্যে তেলওয়াত করি,
“আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই। (তাই, হে প্রভু!) আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করো।” (আল কুরআন-১: ৫-৬)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। এই সিদ্ধান্তসমূহ সঠিক হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’আলাই আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন।
সুতরাং, মন ও আত্মার গভীর সংযোগে আন্তরিকতার সাথে তাঁর নিকট আমাদের সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত, যাতে জীবনে চলার পথে আমরা কল্যাণ অর্জন করতে পারি।
৩) সালাতের মধ্যে দু’আ করুন
সেজদার মধ্যে বা সালাতের পরে দু’আ করুন। দু’আ মূলত আল্লাহর সাথে আমাদের এমন কথোপকথন যার মাধ্যমে আমরা আমাদের চাওয়া-পাওয়াকে তাঁর নিকট তুলে ধরি। আল্লাহর নিকট আমাদের চাওয়াগুলোকে তুলে ধরার জন্য সত্যিকার অর্থে আন্তরিকতার প্রয়োজন, যার মাধ্যমে আমরা খুশু অর্জনের পথে যেতে পারি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে আব্বাস(রাযিঃ) কে বলেন, “আল্লাহর সম্পর্কে সচেতন হও এবং তুমি আল্লাহকে তোমার সাথেই পাবে। যখন তুমি কোনো বস্তুর জন্য প্রার্থনা কর, তখন একমাত্র আল্লাহর নিকটই প্রার্থনা করো এবং যদি তুমি সাহায্য চাও, তবে একমাত্র আল্লাহর নিকটই সাহায্য চাও।” (তিরমিযী)
সুতরাং সালাতের মাঝে খুশু তৈরির জন্য আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন।
৪) প্রতি সালাতে ভিন্ন সূরা তেলাওয়াত করুন
একই সূরা বারবার সালাতে তেলাওয়াত না করে বিভিন্ন সূরার তেলাওয়াতে সালাত আদায় করুন। আমরা যতই ভিন্ন ভিন্ন সূরার সাহায্যে সালাত আদায় করবো, আল্লাহর সাথে আমাদের কথোপকথনের সুযোগ ততটাই বৃদ্ধি পাবে।
মূলত কুরআনের এই সূরাসমূহের মাধ্যমেই আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন। আমাদের উচিত হৃদয় দিয়ে এগুলো অনুধাবন করা, যার মাধ্যমে সালাতের মাঝে যথার্থভাবে আল্লাহর সাথে আমাদের যোগাযোগ তৈরি হয়।
৫) আল্লাহকে নিজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মনে করুন
সালাতে আল্লাহর সাথে এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধনে থাকুন যেমন করে আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে থাকেন। এমনভাবে সালাতে আদায়ের জন্য ছুটে যান, যেভাবে আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে আপনার সারাদিনের বিবরণ ও আপনার সমস্যা সম্পর্কে জানাতে ছুটে যান।
আবেগ-অনুভূতিকে নিকটতম বন্ধুর কাছে প্রকাশের মাধ্যমে আমরা হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ করি। তেমনিভাবে আল্লাহকে ঘনিষ্ঠ মনে করে তাঁর নিকট আমাদের আবেগ-অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশের মাধ্যমেও আমরা শান্তি লাভ করতে পারি।
আল্লাহ বলেন,
“যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার (গোমরাহী) থেকে আলোর (হেদায়াত) দিকে।” (আল কুরআন-২:২৫৭)
সুতরাং সালাতে এমনভাবে প্রবেশ করুন, যাতে আল্লাহ আপনাকে সকল গোমরাহীর অন্ধকার থেকে বের করে হেদায়েতের আলোর দিকে নিয়ে আসেন এবং সেই আলোতে আপনার জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করে দেন।
আল্লাহ আমাদের সকলকে সালাতে যথাযথ খুশু বজায় রাখার তৌফিক দান করুন। আমীন।