সেপ্তিমিয়াস সেভেরাস: রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে উত্তর আফ্রিকাকে মিলিয়েছিলেন যেই সম্রাট

লিবিয়ার উপকূলে লেপতিস ম্যাগনায় পা রাখলে প্রথমেই চোখে পড়বে সেপ্তিমিয়াস সেভেরাস-এর সুউচ্চ তোরণ। দুগ্ধ সফেন শ্বেতপাথরে তৈরি এই তোরণে খোদাই করা রয়েছে সেভেরাস ও তাঁর বংশের সমস্ত ইতিহাস। বলা হয়, লেপতিস ম্যাগনার দক্ষিণাংশের যাদুঘরের কাজ করে সেটি। এখন অবশ্য তার চারপাশে ঝকঝকে আধুনিক পৃথিবী, কিন্তু খানিক কল্পনা প্রবণ হলেই কিন্তু ১৮ শতক আগের ধূলি ধূসরিত একটি পথের দেখা মেলে তোরণের গা ঘেঁষে। যে রাস্তা পশ্চিমে সোওওওজা চলে গিয়েছে কার্থেজ( বর্তমানের টিউনিশিয়া) ও দক্ষিণে গিয়ে মিশেছে সাহারায়।
এই তোরণ শুধু সেভেরাস-এর বংশপরিচয়ই দেয় না, বরং গর্বের সঙ্গে জানায় আফ্রিকা বংশদ্ভূত প্রথম রোমান সম্রাটের দাপট ও সাম্রাজ্যের কথা। সেপ্তিমিয়াস ১৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোম সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন। জুলিয়াস সিজারের পর ১৮ তম শাসক হিসাবে পরিচিত তিনি।
সেপ্তিমিয়াস সেভেরাস-এর জন্ম ও শৈশব
সেপ্তিমিয়াসের জন্ম লেপতিস ম্যাগনায়, ১৪৫ খ্রিস্টাব্দে। এক ধনী পিউনিক বণিক পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। ভূমধ্যসাগর ও তার চারপাশের অঞ্চলের প্রভাব ছিল তাঁর জীবনে শুরু থেকেই। তাঁর পিতা অলিভ অয়েলের ব্যবসা করতেন। প্রথম থেকেই সেপ্তিমিয়াসের পরিবার ফিনিশিয় উপকূলের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে গিয়েছেন। ফিনিশিয় উপকূল বর্তমানে সিরিয়া ও লেবানন নামে পরিচিত। অর্থাৎ, সূক্ষ্মভাবে ইসলামের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তাঁদের। তাঁর মাতৃভাষা ছিল পিউনিক, যা মূলত উত্তর আফ্রিকার ভাষা। যদিও, প্রথাগত শিক্ষা ল্যাটিনেই। ১৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি রোমান সেনেটের পদাধিকারী হন।
রোমান ঐতিহাসিক সেসিয়াস ডিও-র লেখা থেকেই এই মহান সম্রাটের ব্যাপারে বিশদে জানা যায়। জানা গিয়েছে, তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও প্রজাদরদী। বিশেষ করে, রোমান ব্যতীত অন্যান্য প্রজাদের প্রতি তাঁর কোনও বৈরী মনোভাব ছিল না।
অভিষেক ও রাজ্যপাট
সেপ্তিমিয়াসের পূর্ব সম্রাট ছিলেন ডিডিয়াস জুলিয়ানাস। তিনি ছিলেন একেবারে অকর্মন্য ও বিলাসী। সেপ্তিমিয়াস ও অন্যান্য অভিজাতরা মিলে কৌশলে তাঁকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করেন। সিংহাসনে অভিষেক হয় সেপ্তিমিয়াসের। এরপর, দুই কুখ্যাত রোমান সেনাপতি পেসেনিয়াস ও ক্লডিয়াসকে যথাক্রমে ইসহাকের যুদ্ধ ও লাগডুনামের যুদ্ধে পরাস্ত করেন তিনি। নিজেকে মার্কাস অরেলিয়াসের পালিত সন্তান হিসাবে পরিচয় দিতেন তিনি।
সিংহাসন অধিগ্রহণের পরেই রোমান সাম্রাজ্যের বিখ্যাত প্রিটোরিয়ান রক্ষীদের স্থানে নিজের স্বদেশ ও দানিউব নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে রক্ষী নিয়োগ করতে শুরু করেন তিনি। কথিত আছে, তাঁর একার জন্য প্রায় ১৫০০০ রক্ষী ছিল।
সম্রাট হয়েই তিনি প্রথমে সাম্রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার দিকে নজর দিয়েছিলেন। সেনেটের হাত থেকে বিচারের ক্ষমতা সরে যায় প্রিটোরিয় প্রিফেক্টের হাতে। সবার উপরে অবশ্যই ছিলেন সম্রাট। তৎকালীন বিখ্যাত বিচারপতই আলপিয়ানের সাহায্যে তিনি রোমান আইন কানুনেরও প্রভূত পরিবর্তন ঘটান।
তাঁর সাম্রাজ্যে সৈন্যবাহিনী ও মিলিটারির গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি সৈন্যদের বেতন বৃদ্ধি করেন, তাঁদের বিয়ে করার অনুমতিও দেন। শুধু তাই নয়, সেনেটের ভূমিকা আস্তে আস্তে কমিয়ে আনেন বলে সাম্রাজ্যের উপর একচেটিয়া ইতালিয় আভিজাত্যের অধিকার কমতে থাকে।
এছাড়া দরিদ্রদের জন্য নানা সুবিধা দেওয়া, শহরের সৌন্দর্যায়নের জন্য তাঁর কোষাগার ছিল সর্বদা উন্মুখ, আশ্চর্য বিষয়, কোষাগারে ঘাটতি কিন্তু কোনওদিন দেখা যায়নি।
সেপ্তিমিয়াস সেভেরাস-এর সাম্রাজ্যের বিস্তার
১৯৭ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে সেপ্তিমিয়াস তাঁর বাহিনী সমেত পশ্চিমে যাত্রা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পার্থিয়ানদের হাত থেকে মেসোপটেমিয়াকে (বর্তমানে ইরাকে অবস্থিত এই অঞ্চল) রক্ষা করা। তার ঠিক দুই বছর বাদে, মেসোপটেমিয়া রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়।
এরপর বেশ কিছু বছর তিনি রোমান সাম্রাজ্যের উন্নতিকল্পে মনোনিবেশ করেছিলেন। আবার ২০৮ সনে, নিজের ছোটছেলে গেটার সঙ্গে মিলে ব্রিটেন আক্রমণ করেন। ব্রিটেনের যে যে অঞ্চল তখনও রোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না সেগুলোকেও দখল করেন উন্নত যুদ্ধ কৌশলের মাধ্যমে।
সেপ্তিমিয়াসের সাম্রাজ্যের সবচেয়ে উল্লেখ্য বিষয় হল, উত্তর আফ্রিকা ও ইত্যালিয় সংস্কৃতির অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন তিনি। বহু জীর্ণ রোমান মন্দির ও স্থাপত্য যেমন তিনি সংস্কার করেন, নিজে থেকেও অজস্র স্থাপত্য তৈরির নির্দেশ দেন।
২০৮ খ্রিস্টাব্দে, ব্রিটেন জয়ের পরেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কথিত আছে, মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘কখনও সৈন্যদের অবহেলা করবে না। সৈন্যবাহিনীর খেয়াল রাখবে।’
সেপ্তিমিয়াস সেভেরাস আসলে এক ঐতিহ্যের নাম, যে ঐতিহ্যে মিশে যায় উত্তর আফ্রিকা ও রোমান সাম্রাজ্যের মূল সুর।