সোনা-প্ল্যাটিনাম থেকে ভেষজ উদ্ভিদ, নানা সম্পদে পূর্ণ মিশরের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনভূমি

অ্যামাজনের বিশাল অরণ্যের কথা তো সকলেরই জানা, কিন্তু মিশরের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনভূমির কথা শুনেছেন?
এর নাম- এলবা প্রোটেক্টোরেট। এটি হল মিশরের বৃহত্তম প্রাকৃতিক সুরক্ষিত বনাঞ্চল, এর মধ্যে এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ২৯টি প্রোটেক্টোরেট ঘোষণা করা হয়েছে। এটি মিশরের সুদূর দক্ষিণ পূর্বে ৩৫,৬০০ বর্গকিলোমিটার (৩,৫৬০,০০০ হেক্টর) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
ট্যাক্সোনমিস্ট, বোটানিস্ট ও ইকোলজিস্টরা মনে করেন, এলবা প্রোটেক্টোরেট হল পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত আফ্রোট্রপিকাল ইকোজোন।
মিশরের জাতীয় উদ্যান
১৯৮৫ সালে মিশর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই অঞ্চলটিকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করেছিল এবং তখন থেকেই এর দেখাশোনা করে ইজিপশিয়ান এনভায়ারনমেন্টাল অ্যাফেয়ার্স এজেন্সি (ইইএএ)।প্রশাসনিকভাবে এটি মিশরের দক্ষিণ-পূর্ব পূর্বের আবু রামাদ শহরের অংশ।
এখানে রয়েছে বিখ্যাত পর্বত গ্যাবেল এলবা (১,৪৩৭ মিটার উঁচু)। এটি প্রোটেক্টোরেটের সর্বোচ্চ পর্বত না হলেও এর নামানুসারেই সমগ্র প্রাকৃতিক রিজার্ভের নামকরণ করা হয়েছে।
এই অঞ্চলের অন্যান্য উঁচু চূড়াগুলির মধ্যে রয়েছে শেনদিব পর্বত (১,৯১১ মিটার উঁচু), শেনদোদাই পর্বত (১,৫২৬ মিটার উঁচু) এবং শেল্লাল পর্বত (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৪০৯ মিটার উঁচু)।
এই সমগ্র প্রাকৃতিক প্রোটেক্টোরেটেই মিশরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে, এমনকি মিশরের পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের চেয়েও বেশি বৃষ্টিপাত হয় এই অঞ্চলে। এর কারণ হল, এই পর্বতের চেয়ে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে লোহিত সাগর (Red Sea)।
উপকূলীয় পর্বতমালা ছাড়াও, এই প্রোটেক্টোরেট হল বিচিত্র বিস্তৃত ও জটিল প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগার, যা বেশ কয়েকটি বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে; যেমন: লোহিত সাগরের ম্যানগ্রোভ, ২২ টি দ্বীপ, প্রবাল প্রাচীর, উপকূলীয় বালিয়াড়ি, উপকূলীয় লবণাক্ত জলাভূমি এবং উপকূলীয় শুকনো সমভূমি।
এলবা পি.-এর জীববৈচিত্র্য
এখানে রয়েছে অন্তত ৪৫৮ ধরনের উদ্ভিদ প্রজাতি, যা হল মিশরে লিপিবদ্ধ সমস্ত উদ্ভিদ প্রজাতির প্রায় ১৪%-২৫%- এই কারণে জুওলজিস্ট এবং পক্ষীবিদরা এলবা পর্বতকে জীববৈচিত্র্যের হটস্পট বলে মনে করেন। এই ধরনের জীববৈচিত্র্য মিশরের অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষ দেখা যায় না।
এলবা প্রোটেক্টোরেটে চোখে পড়বে অ্যাকাসিয়াস, ডেলোনিক্স, বালানাইটস এজিপটিয়াকা এবং আরও বহু ধরনের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। আর একটু উঁচু জায়গায় ড্রাকেনা ওম্বেট এবং মোরিঙ্গা-র মতো গাছপালা চোখে পড়ে।
এই অপরূপ সুন্দর প্রাকৃতিক রিজার্ভে দেখা যাবে ফার্ন, শ্যাওলা, একাশিয়া টর্টিলিস, ডেলোনিক্স এলাটা, আর্ভা পার্সিকা, ইউফোর্বিয়া চুনেটা এবং চিকিৎসার কাজে উপযোগী নানা ধরনের ওষধি। ম্যানগ্রোভ, অ্যাভিসেনিয়া মেরিনা, রাইজোফোরা মাক্রোনাটা এবং দীর্ঘ উপকূল জুড়ে প্রসারিত লবণাক্ত জলাধারে জন্মানো নানা প্রজাতির গাছ।
উদ্ভিদ ছাড়াও, এলবা প্রোটেক্টোরেটে ৩০ রকম প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে, এক ধরনের উভচর এবং ২৩ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রজাতি, ১৭৩ ধরনের পাখির প্রজাতি ছাড়াও ৩১ ধরনের ওয়াদি এদিব (এদিব ভ্যালি) পাওয়া যায়।
এখানে যে ধরনের পাখি দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে- উটপাখি বা অস্ট্রিচ, ল্যাপেট-মুখী শকুন ইত্যাদি।
এই অঞ্চলের অফ-শোর দ্বীপগুলি বাসস্থান হিসেবে সামুদ্রিক পাখি এবং কচ্ছপদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এলবা প্রোটেক্টোরেট হল সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে ১২৩ ধরনের কোরাল রিফের আবাসস্থল।
ইতিহাস
এলবা প্রোটেক্টোরেটের কাছেই রয়েছে হালায়েব ও আবরাক শহর। তা ছাড়া আবু রামাদ সিটি-ও খুব দূরে নয়। এই অঞ্চলটি প্রাচীন যুগ থেকেই সোনা খনি হিসেবে এবং অন্যান্য মূল্যবান খনিজ উত্তোলনের কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত।
প্রধানত মহাদেশীয় পার্বত্য পাহাড়ী নগরী আব্রাকেই রয়েছে প্রোটো-মিশরীয়দের দ্বারা তৈরি প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকলা এবং প্রাক-রাজবংশীয় নিদর্শনের সমৃদ্ধ ইতিহাস। আবরাকের অভ্যন্তরে আবু সাফা উপত্যকায় খনন কার্যের ফলে প্রাচীন মিশরীয় হাইরোগ্লিফিক্স দিয়ে সাজানো বিভিন্ন বংশের ফ্যারাওদের স্মৃতিচিহ্নগুলি উদ্ধার হয়েছে। তাছাড়া, মাউন্ট আবরাক এবং মাউন্ট ‘আরকা’-র উপরে রোমান দুর্গ এবং প্রাসাদের বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে।
অর্থনৈতিক সুবিধা ও প্রাকৃতিক সম্পদ
এলবা প্রোটেক্টোরেটে পাওয়া যায় এমন অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ভেষজের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহার রয়েছে। এখানকার বেশ কিছু গাছপালা খুব ভালো বায়োফুয়েল এবং পরিষ্কার কয়লার উৎস, এবং বাকিদের কাছ থেকে ভালো কাঠ পাওয়া সম্ভব। তাছাড়াও, কিছু প্রজাতির গাছ থেকে তেল নিষ্কাশণ এবং কিছু অংশ মানুষের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রস্তুত যে ওষুধ ও প্রাকৃতিক উপাদান মিশরে আমদানি করা হয়, এই জাতীয় ওষধি এবং ওষুধের গুণসম্পন্ন উদ্ভিদের উপযুক্ত ব্যবহার মিশরের সেই খরচ হ্রাস করতে পারে।
এই দিক বিবেচনা করে বলা যেতে পারে, তিনটি মহাদেশের মধ্যে মিশর ফাইটোথেরাপির একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে এবং হেলথ-প্রোমোটিং এজেন্টদের মতো প্রাকৃতিক উৎস থেকে নিষ্কাশণ ব্যবহার সংক্রান্ত পড়াশোনার একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
প্রাচীন মিশরীয় যুগ থেকে এই অঞ্চলটি বিভিন্ন ধাতুর পাশাপাশি সোনার খনি এবং জেমস্টোনের জন্য সুপরিচিত। বর্তমানে, ভূতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করেছেন যে এই অঞ্চলে ইউরেনিয়ামের পূর্বরূপ এবং বিরল মূল্যবান ধাতু “প্লাটিনাম” সামান্য পরিমাণে উপস্থিত। এ ছাড়াও, বেশ কয়েকটি রিফাইনারি সংস্থা আবিষ্কার করেছে যে, এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং প্রাকৃতিক তেলের সম্ভার রয়েছে।
ফলে বলা যায়, এই সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভার এই অঞ্চলকে মিশরের পাওয়ার হাউস এবং জীবাশ্ম জ্বালানীর দুর্গে পরিণত করেছে।