স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ

বাংলায় মধ্যযুগের সুলতানি শাসনের ইতিহাস পর্যালোচনা প্রসঙ্গে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বের নিরিখে আমরা তাঁর বহুমুখী চিন্তাধারার পরিচয় পেয়ে থাকি। ইতিহাস কেবলমাত্র জড়, নির্জীব, কতকগুলো ঘটনার তথ্যবিবৃতি নয় বরং ইতিহাসকে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নানা নামে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাস যে অনেকাংশেই গভীর চিন্তা-চেতনার ফসল, এককথায় বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার ফসল এমনটা অনেক ঐতিহাসিকই স্বীকার করেছেন। ঐতিহাসিক বিউরি জানাচ্ছেন, ‘History is a science nothing more and nothing less’… বস্তুত ইতিহাসের এই তত্ত্বসূত্রটি ধরে আমরা বলতে পারি মধ্যযুগীয় ইতিহাসের চর্চা এবং আধুনিক ইতিহাস চর্চাতে রয়েছে এক সংযোগসূত্র।
বাংলায় জাতীয়তাবাদের জনক
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের কথা আলোচনা প্রসঙ্গেও আমরা এই ঐতিহাসিক সূত্রটি খোঁজার চেষ্টা করব। ইলিয়াস শাহ ছিলেন পূর্ব পারস্যের সিজিস্তানের অধিবাসী। তাঁর পিতার নাম সুলতান। ইতিহাসের পাতায় শামসুদ্দিন ‘ইলিয়াস শাহী’ বংশের প্রতিষ্ঠাতা রূপেই নয়, তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে তিনি একই প্রশাসনিক কাজের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন… তিনি উড়িষ্যা এবং নেপালের ত্রিহুত অঞ্চল পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য প্রসার করেছিলেন। তিনিই প্রথম ‘‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’’ উপাধি ধারন করেন। তিনিই প্রথম শাসক যিনি বাংলা নামক বর্তমান যে অঞ্চলগুলোকে বোঝানো হয় সেসব অঞ্চলকে সর্বপ্রথম ভৌগলিকভাবে একত্রিত করার কৃতিত্বের দাবীদার। ঐতিহাসিকেরা বিভিন্ন তথ্য এবং ধারণার ভিত্তিতে এমনটাই মত প্রকাশ করেছেন।
ইলিয়াস শাহ প্রথম জীবনে দিল্লির সুলতানদের অধীনে কাজ করতেন। কিন্তু প্রশাসনিক কোনও কাজের ত্রুটির জন্য তিনি বাংলায় চলে আসেন। বাংলাতে তিনি দিল্লির প্রাদেশিক গর্ভনর ইজাজউদ্দিন ইয়াহিয়ার অধীনে কাজ করতে শুরু করেন। তবে ১৩৩৮ সালে ইজাজউদ্দিনের মৃত্যুর পরে তিনি সাতগাঁওয়ের ক্ষমতা দখল করেন এবং একে দিল্লির অধীন থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন… বলা যায় এই প্রচেষ্টার পরবর্তী সময় থেকেই বাংলা প্রদেশে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ১৩৪২ সাল নাগাদ টানা দুইবছরের যুদ্ধ শেষে তিনি লখনৌতির শাসক আলাউদ্দিন আলি শাহকে পরাজিত করে লখনৌতি অধিকার করেন।
কেন তাঁকে বলা হয় ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ ?
ইলিয়াস শাহী বংশ ১৩৪২ সাল থেকে ১৪১৫ সাল পর্যন্ত একটানা ৭৩ বছর ধরে অবিভক্ত বাংলা শাসন করে এবং এরপর মাঝখানে প্রায় ২০ বছর বাদ দিয়ে আরো ৫২ বছর তাদের শাসন কায়েম থাকে। ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তার পূত্র সিকান্দার শাহ ক্ষমতায় আসেন। বাঙালি চিন্তা চেতনার সামগ্রিক বিকাশ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রদেশকে একত্রীত করে বাঙালি ভাষাভাষি মানুষের মনে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার জন্য তিনি ছিলেন অন্যতম অধিকর্তা। ইলিয়াস শাহ কর্তৃক লখনৌতি, সাতগাঁও, সোনারগাঁও প্রভৃতি প্রদেশ একই প্রাদেশিক ছত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ ইলিয়াস শাহকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’, ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ এবং ‘শাহ-ই-বাঙালিয়ান’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইলিয়াহ শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন এই প্রদেশটির স্থায়িত্ব প্রায় দুশো বছরেরও বেশি সময় জুড়ে রক্ষা পায়। এই প্রদেশে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মোঘল সম্রাটেরা বাঙ্গালাহকে মোঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবাহ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। প্রদেশটির নাম তখন হয় সুবাহ-ই-বাঙ্গালাহ। পোর্তুগিজ বণিকেরা পরবর্তী সময়ে যখন এই প্রদেশে এসে তাঁদের একাধিপত্য স্থাপন করেছিলেন তখন কিন্তু তারা বাংলাকে এই নামেই চিনতে শেখে। ইতিহাসের পাতায় শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনার প্রেক্ষাপট অবশ্য নেই। কিন্তু বাংলা এবং বাঙালি জাতির মধ্যে একাকিত্ব বোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক… বহু শতক পার হয়ে ১৯৭১-এ বাঙালি সমাজের একীভূত চেতনার স্বরূপ আমাদের বিশেষভাবে চোখে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। সুতরাং, এমনটা বলাই যায় ইতিহাসের গতি বহুরৈখিক এবং বহুমাত্রিক হলেও ঘটনা পরম্পরার মধ্যে সংযোগ সূত্র পাওয়া যায়, আর সেই সূত্রেই ইতিহাসচর্চাকে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার সঙ্গে তুলনা করলেও অত্যুক্তি হয় না।