হাইরোগ্লিফিকের প্রথম পাঠকর্তা আজ বিস্মৃতির আড়ালে

কোনও বিতর্কে না গিয়েই বলা যেতে পারে যে, মিশরীয় হাইরোগ্লিফিক লিপি যেভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা অন্য কোনো প্রাচীন লিপি করতে পারেনি।গত কয়েক শতক ধরে বহু দেশের সম্রাট, বহু বিদ্বান ব্যক্তি, পর্যটক, দুর্ধর্ষ ডাকাত এবং আরও অনেকে মিশরের স্মৃতিস্তম্ভগুলির প্রাচীরের গায়ে পাথরের মধ্যে আঁকা রহস্যজনক চিহ্ন এবং ছবিগুলি পরীক্ষা করে তাদের অর্থ বোঝার চেষ্টা করেছেন। ১৮২০-এর দশকে ফরাসি পন্ডিত জঁ-ফ্রঁসোয়া শঁপইয়ঁ অবশেষে সেই দুর্বোধ্য লিপি পাঠোদ্ধার করেন।তিনি মিশরের গৌরবময় প্রাচীন ইতিহাসকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন এবং তাকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন যা আগে কখনও সম্ভব হয়নি।
হাইরোগ্লিফিক লিপি প্রথম পাঠোদ্ধারের গুরুত্ব
কিন্তু সত্যিই কি শঁপইয়ঁ প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি মিশরীয় হাইরোগ্লিফিকের সফলভাবে পাঠোদ্ধার করতে পেরেছিলেন? ইজিপ্টোলজিতে তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তিনি অবশ্যই কৃতিত্বের অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে, এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল শঁপইয়ঁ-এর জন্মের প্রায় হাজার বছর আগে। কারণ নবম শতাব্দীর শেষের দিকে, আবু বকর ইবন ওয়াহশিয়া নামের একজন অ্যালকেমিস্ট মিশরীয় হাইরোগ্লিফিক লিপির অর্ধেকেরও বেশি প্রতীকের ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সময়ে অন্তত ৭00-৮00 ধরনের প্রতীকের ব্যাখ্যা প্রয়োজন ছিল যার অনেকটাই তিনি করতে পেরেছিলেন, ফলে এই সাফল্যকেও অবশ্যই সম্মান জানানো প্রয়োজন।
ইবন ওয়াহশিয়ার এই অবদানের কথা ২০০৪ সালে লন্ডনের মিশরবিদ তথা ইউসিএল-এর ইনস্টিটিউট অফ আর্কিওলজির অধ্যাপক ডঃ ওকাশা এল ডালি দ্বারা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এল ডালি মধ্যযুগীয় আরব-ইসলামী লেখায় প্রাচীন মিশরের অধ্যয়ন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছিলেন এবং অকাট্য যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে, মুসলমানরা যে শুধু এই প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে অধ্যয়নের প্রতি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তা-ই নয়, তারা মিশরীয় হাইরোগ্লিফিক লিপি সঠিকভাবে পাঠোদ্ধারও করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু কে এই ইবন ওয়াহশিয়াহ?
কেন তিনি হাইরোগ্লিফিকের পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করছিলেন? তাঁ
র পটভূমি সম্পর্কে আমাদের কাছে যে সামান্য তথ্য রয়েছে তা যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর।
যদিও বলা যায় যে, তিনি সম্ভবত আরবের একটি বিদ্বান খ্রিস্টান পরিবার থেকে এসেছিলেন যারা পরবর্তী কালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
আব্বাসীয় যুগের প্রথম দিকে তিনি কুফায় (ইরাক) বসবাস করতেন।
তখন নিকটবর্তী বাগদাদের বিখ্যাত হাউস অফ উইজডম-এ পন্ডিত ও বৈজ্ঞানিক আন্দোলন পুরোদমে চলছিল।
তিনি একজন অ্যালকেমিস্ট ছিলেন। মনে করা হয়, প্রাচীন মিশরীয়দের গোপন অ্যালকেমি বিদ্যা আবিষ্কার করার আশায় তিনি এই রহস্যময় লিপি পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন।
হাইরোগ্লিফিকের পাঠে ইবন ওয়াহশিয়ার কাজের গুরুত্ব
তিনি অন্যান্য ক্রিপ্টিক বর্ণমালাও পাঠোদ্ধার করেছিলেন – যার মধ্যে রয়েছে ৯৩টি প্রাচীন ভাষা যা ব্যাবিলনীয়, মিশরীয়, সেমেটিক, হেলেনীয়বাদী এবং হিন্দু সভ্যতায় ব্যবহৃত হত। তিনি তাঁর আবিষ্কার সম্বন্ধে কিতাব শওক আল-মুস্তাহাম নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন।
সেখানে তিনি হাইরোগ্লিফিক চিহ্নগুলির একটি তালিকা দিয়েছেন, এবং তার সাথে রয়েছে তাদের অর্থ (শব্দ বা অক্ষর হিসাবে) এবং তাদের আরবী প্রতিশব্দ। এই ব্যাখ্যাগুলিকে এল ডালি আধুনিক মিশরবিদদের হাইরোগ্লিফিকের ব্যাখ্যার সাথে তুলনা করেছেন এবং প্রত্যেকটি চিহ্নের অর্থ ইবন ওয়াশিয়া সঠিক উদ্ধার করেছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
ইবন ওয়াহশিয়ার অবদানের আবিষ্কার ইজিপ্টোলজির ক্ষেত্রে ধ্রুপদী মুসলিম চিন্তাবিদদের ভূমিকার আলোচনার সূচনা করে, যাকে গত কয়েক শতাব্দী ধরে উপেক্ষা করা হয়েছিল। তার একটি কারণ হিসেবে বলা যায় ইতিহাসের উপর চিরাচরিত ইউরোপ-কেন্দ্রীক প্রভাব এবং দ্বিতীয় কারণ হল, এই সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক পাণ্ডুলিপিগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে সেগুলি ইতিহাস পর্যালোচনার সময়ে বিবেচনাই করা হয়নি। এল ডালির এই গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার কয়েক বছর পরে কিছু ইতিহাসবিদ ইবন ওয়াহশিয়াহকে ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত মিশরবিদ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছেন।
এল ডালি জোর দিয়েছিলেন যে, ইসলাম সম্পর্কে তাদের নির্দিষ্ট কিছু ধারণার কারণে, পশ্চিমা পন্ডিতরা ধ্রুপদী মুসলিম ইজিপ্টোলজিস্টদের প্রতি অবিচার করেছেন। তিনি বলেন, “পশ্চিমী সংস্কৃতি ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করে কারণ আমরা [পশ্চিমে], কুরআন শরিফ-এর আগে [সভ্যতার] শিক্ষার কথা মনে করি, যা সঠিক নয়।” “তারা ইতিহাসকে মর্যাদা দিয়েছিল এবং মিশরকে বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেশ বলে স্বীকার করেছিল। ফলে তারা এই বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডারের খোঁজ পাওয়ার জন্য তাদের ভাষা শিখতে চেয়েছিল।”
বাস্তবে, ধ্রুপদী মুসলমানরা ইজিপ্টোলজি নিয়ে যে গবেষণা চালিয়েছিলেন তা প্রাক-আধুনিক খ্রিস্টান ইউরোপে তাঁদের সমসাময়িকদের গবেষণার তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। “তারা [অর্থাৎ মুসলিমরা] পশ্চিম দেশগুলির মতো বিক্ষিপ্ত ভাবে তৎকালীন ধর্মীয় ধারণার সাথে খাপ খাইয়ে দেওয়ার জন্য ইতিহাস লেখেনি, ফলে তাদের বিবরণগুলি আরও অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য, ”এল ডেলি বলেছেন। “তারা মানবজাতির উদ্ভব এবং তাদের চেহারা ও ভাষার বৈচিত্রের ভিত্তিতে সার্বজনীন মানব ইতিহাস রচনার বিষয়ে আগ্রহী ছিল।”
প্রাচীন সভ্যতা ও হাইরোগ্লিফিকঃ
প্রাচীন সভ্যতাগুলি সম্পর্কে যে সাধারণ মনোভাব রয়েছে ইবন ওয়াশিয়া হলেন তার মধ্যে একটি উদাহরণ, যার কথা ডঃ এল ডেলি তাঁর বিবৃতিগুলিতে বর্ণনা দেওয়ার সময়ে উল্লেখ করেছেন।ইবন ওয়াহশিয়াহের সময়ের কিছু আগে, বিখ্যাত আব্বাসীয় খলিফা আল-মা’মুন সামরিক অভিযানের জন্য মিশর সফর করেছিলেন এবং একজন সন্ত আইয়ুব ইবন মাসলামাহকে তাঁর জন্য আকর্ষণীয় হাইরোগ্লিফিকের পাঠোদ্ধার করার জন্য চেষ্টা করতে বলেছিলেন। আইয়ুব ব্যর্থ হয়েছিলেন, তবে মা’মুন গিজার মহান পিরামিডের বন্ধ প্রবেশদ্বারটি খুলতে সফল হয়েছিলেন যা পর্যটকরা আজও ব্যবহার করেন। রসায়নের জনক হিসাবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত জাবির ইবন হাইয়ানও হাইরোগ্লিফিক লিপি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র সম্পর্কে এই লিপিতে কোনও রহস্য থাকতে পারে বলে তিনি মনে করতেন।
একই ভাবে, নবম শতাব্দীর সুফী সন্ত ধূ’ন-নুন আল-মিস্রিও মিশরীয়দের হাইরোগ্লিফিকের সম্পর্কে গভীর আগ্রহী ছিলেন। ধ্রুপদী ঐতিহাসিক আল-মাসউদি তাঁর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “এই [মিশরীয়] মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ইতিহাসকে যাঁরা ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি তাঁদের সাথে ঘোরাঘুরি করেছিলেন এবং প্রচুর পরিমাণে চিত্র ও লিপি পরীক্ষা করেছিলেন।” বলা হয় যে, ধূ’ন-নুন আল-মিস্রি হাইরোগ্লিফিক লিপির বহু সঙ্কেতের মানে উদ্ধার করেছিলেন। এটি সত্যি হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই কারণ, মনে করা হয় যে তিনিই প্রথম এই প্রাচীন প্রতীকগুলি সম্পর্কে নিজস্ব ব্যাখ্যা তৈরি করেছিলেন।
এমন আরও অনেক উদাহরণ থাকতে পারে, যা হয়তো এখনও আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে। হতে পারে, অন্য কোনও মুসলমান হাইরোগ্লিফিক লিপি সম্পূর্ণরূপে পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে আমাদের কাছে যা সূত্র রয়েছে, তার উপরে ভিত্তি করে আমরা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে শঁপইয়ঁ তাঁর কাজ শেষ না করা পর্যন্ত প্রথম প্রকৃত মিশরবিদ ইবন ওয়াহশিয়া প্রায় এক হাজার বছর আগে হাইরোগ্লিফিক লিপি পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন। মুসলমানরা আজও একই মনোভাব ও উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক রহস্য অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছেন যার ফলে ভবিষ্যতে আরও অনেক অজানা তথ্য হয়তো জানা যাবে।